সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে পূণ্যবান অথবা পূণ্যবতী নর-নারীকেও শাস্তি দেন। কেন গ্রিক উপকথার রাজা ইডিপাসকে দেননি? প্রাচীন রুশ উপকথায়ও এমনি একটি কাহিনি আছে। রাশিয়ার কোনো এক রাজ্যের রাজা ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। কিন্তু গড বা ঈশ্বরের কোনো নির্দেশের তোয়াক্কা করতেন না। তার মৃত্যুর পর দেবদূতেরা সমস্যায় পড়লেন—রাজাকে স্বর্গে না নরকে পাঠাবেন? তার চরিত্রে কোনো পাপ নেই। সুতরাং তাকে স্বর্গে পাঠানো উচিত। অন্যদিকে রাজা ঈশ্বরের কোনো আদেশ মানেননি, সেজন্য তাকে নরকে পাঠানো দরকার।
এরকম আরেকটি গল্প আছে মোগল আমলের। সম্রাট শাহজাহান বৃদ্ধ হওয়ার দরুন সাম্রাজ্যের শাসনভার পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিন্ধান্ত নিয়ে সভাসদদের ডেকে তার ইচ্ছার কথা বললেন। বললেন, দাক্ষিণাত্যে প্রায়ই বহিরাক্রমণ হয়, সেখানে তিনি ছোট ছেলে যোদ্ধা স্বভাবের আওরঙ্গজেবকে পাঠাবেন। বড় ছেলে দারাশিকোকে দিল্লিতে রাখবেন। সে হবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। মেজো ছেলে মুরাদকে ভার দেবেন উত্তরা পথের। কেবল সেজো ছেলে শাহ সুজাকে পাঠাবেন বাংলা বিহার উড়িষ্যা
দেবদূতদের এই সমস্যা ঈশ্বর নিজেই মিটিয়ে দিলেন। বললেন, রাজাকে স্বর্গ অথবা নরকে কোথাও পাঠানোর দরকার নেই। তাকে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও। তবে তার আগের রাজ্যে নয়, পাশের রাজ্যের রাজা করে পাঠাও, যেখানে একজন মানুষও সত্ নয়। তারা অত্যাচারী, লম্পট, সব ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধে জড়িত। সারাটা রাজ্য পাপ ও অনাচারে পূর্ণ। দেখি, এই রাজ্যের অধিপতি হয়ে কী সাফল্য সে দেখাতে পারে। এই রাজ্যের মানুষকে সামাল দিতে না পারলে তার যে দুর্গতি হবে, সেটাই তার শাস্তি। ঈশ্বরের আদেশ পেয়ে দেবদূতেরা রাজাকে সেই দুর্বৃত্তে ভরা রাজ্যে পাঠিয়ে দিল। তারপর রাজার ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাই বাকি অংশটা লিখলাম না।
সম্রাটের সিদ্ধান্তের কথা জেনে সুজা কেঁদে পিতার পায়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে আপনি পাঠালেন ভালো ভালো এলাকায়। আর আমাকে কিনা পাঠালেন নদীনালা আর ডাকাতের দেশে! আমি কি সুবে বাংলায় গিয়ে ঐ ডাকাতদের শাসন করতে পারব? শাহজাহান বললেন, তুমি নিজেকে আওরঙ্গজেবের চাইতে সাহসী, মুরাদের চাইতে বুদ্ধিমান এবং দারার চাইতে যোগ্য দাবি কর। সে জন্যই তোমাকে সুবে বাংলায় পাঠালাম। এই এলাকার সব উত্পাত দূর করে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারো, তাহলেই বুঝব তুমি ‘সাহসী, বুদ্ধিমান, যোগ’ শাসক।
প্রাচীনকালের রুশীয় উপকথার এবং মোগল যুগের এই দুটি গল্পের কথা মনে পড়ল বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে এসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থা দেখে। তার সব আছে, অথচ কিছুই নেই। মন্ত্রী আছে, এমপি আছে, আমলা আছে, দল আছে; কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে দেখছেন, তার কেউ নেই। তিনি একা। এবং একা যুদ্ধ করছেন দেশটাকে উদ্ধারের জন্য। তিনি যদি পরাজিত হন, তাহলে দেশ ডুববে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ডুববে, অসাম্প্রদায়িক বাংলা ডুববে। আর তিনি যদি জয়ী হন, তাহলে দেশ বাঁচবে, দেশের মানুষ বাঁচবে, স্বাধীনতা বাঁচবে।
দেখেশুনে মনে হয় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নন, তার ভাগ্যবিধাতা চাইছেন কঠিন পরীক্ষার মুখে তাকে ফেলে তার সাহস, ধৈর্য, দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করতে। বঙ্গবন্ধুকেও এই পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল।… একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো অসাধ্য সংগ্রামে জয়ী হওয়ার পরও তাকে রমনার মাঠের জনসভায় দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছিল, ‘আমার চারদিকে শুধু চাটার দল। আমার দুঃখী মানুষের জন্য বিদেশ থেকে যে ভিক্ষে চেয়ে আনি, তা এই চাটার দল চেটেপুটে খায়।’ শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এই চাটার দল সম্পর্কে অনেক বলেছেন। সম্ভবত তিনি এই চাটার দলের কবল থেকে দেশটাকে মুক্ত করতে পারবেন এই আশা মনে পোষণ করছেন এখনো।
শেখ হাসিনাকে এই দুঃসাধ্য কাজ সাধনের জন্য; তার সাহস, দক্ষতা ও যোগ্যতা পরীক্ষার জন্য কে তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন? সে তার ভাগ্যবিধাতা! নইলে কেন তিনি অকালে পিতা-মাতাসহ পরিবারের লোকজন হারিয়ে একা হয়ে যাবেন? যে সময় স্বামী, পুত্র-কন্যা নিয়ে সংসার করবেন, সেই সময় কোমরে আঁচল বেঁধে কেন লড়াইয়ের মাঠে নামবেন? নিশ্চিত মৃত্যু, গ্রেনেড হামলার মুখে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করবেন?
মাতৃহূদয় নিয়ে তিনি এই চাটার দলকে দমন করতে পারবেন না। তাকে আরো কঠোর ও কঠিন হতে হবে। হিন্দু শাস্ত্রে দেবী দুর্গাকে বলা হয় ‘দশ প্রহর ধারিণী’। শেখ হাসিনাকে এক হাতে নয়, দশ হাতে দেশ শাসন করতে হবে। তিনি যে সাহসী দেশনেত্রী তা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি যে দক্ষ শাসক, তা-ও তিনি তার তিন মেয়াদের শাসনকালে প্রমাণ করেছেন। একটি দুর্ভিক্ষপীড়িত, দরিদ্র দেশকে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সেরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করেছেন। সাম্প্রদায়িক জোটকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছেন। স্বাধীনতার শত্রু যদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দিয়েছেন। জাতির পিতা এখন স্বমহিমায় স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। দেশ অর্থনীতিতে বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটিয়েছে। রাজনীতি স্থিতিশীল হয়েছে। এখন করোনার মতো বিশ্বত্রাস দানবের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধরত।
এমন একজন নেত্রী পাওয়ার পর কৃতজ্ঞ জাতির উচিত তাকে দেশ পুনর্গঠনে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সমর্থন দেওয়া। যে সাহায্য ও সমর্থন সিঙ্গাপুরের মানুষ লি কুয়ানকে এবং মালয়েশিয়ার মানুষ মাহাথিরকে দিয়েছে। কিন্তু সেই সাহায্য ও সমর্থন তিনি পাননি। তাই দুর্নীতি ও অনাচারের মহা বটবৃক্ষটি তিনি কেটে ফেলতে পারেননি। দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ, যাদের জন্ম বিএনপির আমলে এবং ঐ আমলেই যাদের বিকাশ, তাদের অনেকেই পরিচয় পালটে আওয়ামী লীগে এসে ভিড়েছেন অথবা আওয়ামী লীগের পরিচয় ভাঙিয়ে দেশটাকে মগের মুল্লুক বানানোর চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তাদের প্রতারণার জাল বিস্তারের সুযোগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এই যে, যথাসময়ে দুর্নীতির এই রাঘব বোয়ালদের শনাক্ত করে দল থেকে বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি।
এ কারণেই দেশে সাহেদ করিমের মতো বিবেকহীন ও মনুষ্যত্ববোধহীন দুর্নীতিবাজের এমন উত্থান সম্ভব হয়েছে। উত্থান সম্ভব হয়েছে পাপুলের মতো আদম ব্যবসায়ীর। সাহেদ করিম আজকের নয়, বিএনপি আমলের দুর্নীতির রাজা। তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের সঙ্গে সে যুক্ত ছিলো এবং তখনই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গিয়েছিল। বিএনপি আমলের দুর্নীতির এই রাঘব বোয়াল কী করে র পালটে আওয়ামী লীগে ভিড়ে গেল, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সঙ্গে মেলামেশার, ছবি তোলার এবং তার দুর্নীতির কাজে তাদের নাম ব্যবহারের সুযোগ পান, তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
তার যে হাসপাতালের কয়েক বছর যাবত্ অনুমোদন নেই, সেই হাসপাতাল কেমন করে করোনা রোগী চিকিত্সায় (ভুয়া চিকিত্সায়) প্রশংসা পায়, কারা তাকে এই সার্টিফিকেট দিলেন, তা-ও খতিয়ে দেখার ব্যাপার। দেশে পুলিশ, র্যাব, সিক্রেট সার্ভিসেস সবাই এখন শক্তিশালী। তার পরও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অথবা তদন্তাধীন একাধিক বিত্তশালী ব্যক্তি স্পেশাল প্লেন ভাড়া করে আমাদের দেশেরই এয়ারপোর্ট থেকে কী করে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে, তা ভাবলে পাগল হতে হয়।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো দুর্নীতির আড্ডা বলে পরিচিত। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো স্বপদে বহাল থাকেন কী করে? যে খবর শুনে হতবাক হয়েছি তা হলো, আমাদের একশ্রেণির ডাক্তার করোনা রোগ শরীরে বহন করছে এমন কয়েক হাজার মানুষকে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এসব মানুষ বিমানযাত্রী হয়ে বিদেশের এয়ারপোর্টে পৌঁছে ধরা পড়েছেন। এদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপর আর কোনো বাঙালি যাত্রী বহনকারী বিমানকে হয়তো কোনো দেশের আকাশসীমানায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য দারুণ কলঙ্ক বহন করবে।
করোনা শনাক্ত মানুষকেও হাজার হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে করোনামুক্ত বলে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা কারা করেছেন? তারা আমাদের দেশেরই একশ্রেণির ডাক্তার। খবের জেনেছি, এক মহিলা ডাক্তার (নামটি লিখলাম না) একাই দেড় হাজারের বেশি ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন। এই খবর লন্ডনে এসে পৌঁছার পর আমার এক বন্ধু তা শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন, গোটা জাতি যদি দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তাহলে শেখ হাসিনা একা কী করবেন? তার অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি, আমলা, দলের নেতা যদি দুর্নীতিপরায়ণ হন, দেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে যদি দুর্নীতি ঢুকে পড়ে, তাহলে শেখ হাসিনার একার পক্ষে এই দানবকে দমন করা সম্ভব নয়। সম্ভব হবে যদি তিনি দুর্নীতিমুক্ত একটি প্রশাসন ও দলের সমর্থন পান। তিনি তা পাচ্ছেন না। তিনি আজ বড় একা এবং অসহায়।
আমি এই বন্ধুর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। গোটা বাঙালি জাতিটাকেই আজ যেন দুর্নীতি গ্রাস করেছে। আল্লাহতায়ালা তার ফেরেশতা পাঠিয়ে এই দুর্নীতি দমন করতে পারবেন কি না, সন্দেহ। আজ থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগে আবুল মনসুর আহমদ বাঙালিদের দুর্নীতিপরায়ণতা সম্পর্কে একটি গল্প লিখেছিলেন। নাম ‘সায়েন্টিফিক বাঙালি’। গল্পের উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন, যদি গোটা বাঙালি জাতিকে আগুনে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে ফেলা হয়, তাহলে সেই ছাই থেকে দুর্নীতির চারা গাছ থামা তুলবে।
শেখ হাসিনা প্রবীণ সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের গল্পে বর্ণিত দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আছেন। তিনি দারুণ সংগ্রাম করে যা অর্জন করেন, তা ব্যর্থ করার জন্য তার চারপাশেই রাঘব বোয়ালের দল তত্পর। এই রাঘব বোয়ালদের দমন করা করোনা মোকাবিলার চাইতেও দুরূহ। কিন্তু এই দুরূহ কাজটিই ভাগ্যবিধাতা হাসিনার ওপর চাপিয়ে তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন। তাকে এই পরীক্ষায় জয়ী হতে হবেই।