রাজধানীর কুড়িল চৌরাস্তায় গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার চিত্র। যাত্রীর অপেক্ষায় রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ১২-১৩ জন চালক। দু-একজন যাত্রী এলেই সবাই একযোগে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তাঁদের মধ্যে এক বৃদ্ধ রিকশা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম নূরুল ইসলাম। সকালে মুড়ি খেয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন। কিছু রোজগার করে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরলে স্ত্রী দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে পারবেন। ওই সময় পর্যন্ত রোজগার হয়েছে মাত্র ৭৫ টাকা। তা থেকে রিকশার মালিককে জমার টাকা কী দেবেন আর বাজারই বা কিভাবে হবে
তিনি বলেন, ‘ঘরে মা-বাবা, বউ ও দুটি মেয়ে আছে। রিকশার চাকা না ঘুরলে তাদের পেটে খাবার যাবে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ৩০০ টাকাও কামাই হয় না। করোনার আগে এমনও দিন ছিল এক হাজার টাকা পর্যন্ত কামাই হতো। এখন রিকশার জমার টাকা দিয়ে কোনোমতে খাবারের ব্যবস্থা হলেও ঘর ভাড়া দিতে পারছি না।’
রামপুরা ওয়াপদা রোড এলাকায় পেশা পরিবর্তন করে পেটের দায়ে রিকশা চালাচ্ছেন লাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘১৬ হাজার টাকা বেতনে গাজীপুরে একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। করোনার কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপায় না পেয়ে রিকশা চালাচ্ছি। গ্রামের বাড়িতে বাবা, দুটি ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে। একমাত্র আমার রোজগারে সংসার চলে। কিন্তু সারা দিন রিকশা চালিয়েও জমা আর নিজের খরচই জোগাতে পারি না। বাড়িতে টাকা পাঠাব কিভাবে
১৩ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন গাইবান্ধার সাইফুল। তিনি বলেন, ‘সকালে রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। দুপুর পর্যন্ত কামাই হয়েছে মাত্র ১১০ টাকা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আর কত কামাই হবে, জানি না। আবার জমা না দিতে পারলে কাল থেকে মালিক রিকশা দেবে না। এদিকে যাত্রীও পাওয়া যায় না।’
হিরন মিয়া রিকশা চালান রাজধানীর তিন শ ফিট এলাকায়। তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে এখন যাত্রীর চেয়ে রিকশা বেশি হয়ে গেছে। একটা যাত্রী এলে সবাই কাড়াকাড়ি লেগে যায়। এ কারণে ৩০ টাকা ভাড়ার দূরত্বে ২০ টাকায় নিয়ে যেতে হচ্ছে।’
রাজধানীজুড়ে এমন হাজার হাজার রিকশাচালক রয়েছেন, যাঁরা পেটের দায়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন। কিন্তু যাত্রী মিলছে না। বেশির ভাগ রিকশাচালককেই অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ফলে একেবারেই যাত্রী পাচ্ছেন না রিকশাচালকরা।
সারা দিন রিকশা চালিয়ে জমা (ভাড়া রিকশার দিনপ্রতি খরচ) ১০০ টাকা দেওয়ার পর অবশিষ্ট তেমন কিছু আর থাকে না। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোমতে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাঁদের। এদিকে চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করে অনেকে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
মহানগরীতে লাইসেন্সধারী বৈধ প্রায় ৮৬ হাজার রিকশা রয়েছে। তবে এই লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে প্রায় দুই যুগ ধরে। আর এ সময়ে ২৫টি সংগঠনের বাণিজ্যে প্রায় ১২ লাখের বেশি রিকশা চলছে নগরীতে। আর এসব রিকশার পেডাল ঘোরান একবারেই হতদরিদ্র মানুষগুলো। তাঁদের শ্রম-ঘামে উপার্জিত অর্থের বড় একটা অংশই চলে যায় জমার নামে মালিকদের পকেটে। অন্য সময় উপার্জন থেকে সেই জমার টাকা নিয়মিত দিতে পারলেও বর্তমান সময়ের এই করোনা সংকটে অনেকেই আর পারছেন না। কিন্তু তা দেখার সময় ও মানসিকতা কোনোটাই নেই মালিকদের। আয় হোক না হোক জমার টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে হবে। নইলে পরদিন থেকে আর রিকশা মিলবে না।
এ ব্যাপারে কথা হয় রাজধানীর কুড়িল যমজ রোডে রিকশার গ্যারেজ মুর্শিদা এন্টারপ্রাইজের মালিক হুমায়ুনের সঙ্গে। বাধ্য হয়েই প্রতিটি রিকশায় আমরা এক শ টাকা জমা নিচ্ছি। কারণ গ্যারেজ ভাড়া ও মিস্ত্রি খরচ আছে। করোনার কারণে আমরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার গ্যারেজে ৭৬টি রিকশা রয়েছে। এর অর্ধেকই চলে না। আয় কম দেখে রিকশা রেখে গ্রামে চলে গেছে অনেকেই।’