উত্তাল মেঘনা গিলে খায় মনিরুল মোস্তফার ঘরবাড়ি। এরপর পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন ঢালচরে। সরকার থেকে এক একর জমিও বন্দোবস্ত পান তিনি (নথি নম্বর ৯০)। তবে সাবেক সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর লোকজন মারধর করে তাঁকে উচ্ছেদ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে পরিবার নিয়ে চরের অন্য প্রান্তে খুপরিঘর তুলে বসবাস করছেন।
জমিটি ফেরত পেতে মনপুরার চৌধুরীবাড়িতে গিয়ে অনেক আকুতি জানিয়েছিলাম, কিন্তু একটুও মন গলেনি ওদের। উল্টো আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় নাজিম উদ্দিনের লোকজন।
অভিযোগ সত্তরোর্ধ্ব ভূমিহীন বেলায়েত হোসেনের। ১৯৬০-৬১ সালে ৮৩ নম্বর নথির মাধ্যমে হাতিয়া উপজেলা প্রশাসন থেকে আড়াই একর জমি বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন তিনি। সেই জমি থেকে ১০ বছর আগে নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর ক্যাডার বাহিনী তাঁকে উচ্ছেদ করেছে। বেলায়েত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের ভিটামাটি নদী খেয়েছে, আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। সচিবের অর্ডারি পুলিশ দিয়ে আমাদের জমি দখল করে নিল। রাত পোহালেই সচিবের জমি বাড়ে আর ঢালচরের ভূমিহীনদের জমি কমে। ঢালচরের পশ্চিমে যতটুকু চোখ যায় শুধু সচিবের জমি আর জমি।’ বেলায়েত বলেন, ‘বলতে পারবেন, আর কত জমি পাইলে সচিবের কলিজাটা ভরবে? আর কত জমি দরকার চৌধুরীর?’ কথা শেষ না হতেই কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরে নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ছয় হাজার বিঘা জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ আছে সাবেক এই আমলার বিরুদ্ধে। সেখানে শতাধিক মাছের খামারসহ হাঁস, মহিষ, গরু ও ছাগল-ভেড়ার খামার করেছেন। দুর্গম চরে তিনি নির্মাণ করেছেন হেলিপ্যাডসহ আলিশান বাড়ি।
রাজধানীর গুলশানে আট কোটি টাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন সাবেক জ্বালানিসচিব নাজিম চৌধুরী। স্ত্রী-সন্তানের নামে বনানী ও মোহাম্মদপুরে আছে ১১ কোটির দুটি ফ্ল্যাট ও বাড়ি। চলাচল করেন লেক্সাস ও ল্যান্ড ক্রুজার ব্র্যান্ডের দামি গাড়িতে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভগ্নিপতি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর প্রভাব খাটিয়ে ঢালচর থেকে ভূমিহীনদের জমি দখলে নেওয়া শুরু করেন নাজিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে কৌশলে ভূমিহীনদের বিতাড়িত করতে থাকেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব হয়ে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ঢালচরের মানুষের নিরাপত্তার কথা বলে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করান তিনি। তবে পুলিশ তাঁর ‘লাঠিয়াল বাহিনী’তে পরিণত হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
৩৫ বছর ধরে ঢালচরে পরিবার নিয়ে বাস করা নোয়াখালীর হাতিয়ার হরিণী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মোস্তফার জমিও (সরকারি বন্দোবস্ত) কেড়ে নিয়েছেন নাজিম চৌধুরী। প্রতিবন্ধী মোস্তফা বলেন, ‘হেতে (নাজিম চৌধুরী) আমার বেক জমি নিয়ে গেছে। হেতে বাহিনী দিয়া অনেক মারছে। জমি চাইতে গেছি হেতের কাছে, হেই সময় আবারও মারছে।
আজগর আলী বলেন, ‘হেতে কুটি কুটি টেহার মালিক। পেলনে (হেলিকপ্টার) মাঝেমধ্যে আসে। অস্ত্রউলা ক্যাডার বাহিনী থাহে। আর হেতের অর্ডারি পুলিশ দিয়া মারধর করায়, মামলা দেয়। সচিবের পাহারার জন্য নাকি পুলিশ দিছে সরকার, আমরার লাগি ন।’ এ সময় কেঁদে ফেলেন মোস্তফা।
ভূমিহীন মাহাবুবুর রহমান বলেন, সরকার থেকে জমি বরাদ্দ পেয়ে সাড়ে চার হাজার পরিবার ঢালচরে ছিল। নাজিম চৌধুরীর অত্যাচার-নির্যাতনে অনেকে চলে গেছে। এখন আছে তিন হাজার পরিবার। পরিশ্রম করে ধান, ডালসহ বিভিন্ন ফসল ফলায় তারা। কিন্তু সচিবের লোকেরা লুট করে নিয়ে যায়, ফসলে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে ডাল ও ধান মাড়াই করে স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। সেই স্তূপে সচিবের বাহিনী আগুন লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রায় সাড়ে সাত হাজার একর আয়তনের চরটিতে বসবাস করছে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া দুই হাজার ৫৫৩ পরিবার। পাশাপাশি আরো দুই হাজার পরিবারের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। নাজিম চৌধুরীর স্বজনদের দাবি, ডেমপিয়ার অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম নামে ঢালচরে তাঁদের পরিবারের লিমিটেড কম্পানির ৫৬৭ একর জমি রয়েছে। কম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন নাজিম চৌধুরীর বাবা বশারত উদ্দিন চৌধুরী। বর্তমানে এ পদে রয়েছেন চাচা কামাল উদ্দিন চৌধুরী।
তবে সরকারের ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র ঘেঁটে এ দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার আগে ১৯৬০-৬১ সালে প্রথম পর্যায়ে ঢালচরে এক হাজার ১৫৩টি নথিতে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৯৭ সালে কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা জারির পর হাতিয়া উপজেলার আরো এক হাজার ৪০০টি ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত মোট চার হাজার ২৮২ দশমিক ৫০ একর ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। নাজিম উদ্দিন বা তাঁর পরিবারের কারো নামে বন্দোবস্ত কিংবা মালিকানার কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।
এই চরে নাজিম চৌধুরীদের দুই একর জমি আছে। তাদের অভিযোগ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় ঢালচরের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেন নাজিম চৌধুরীর বাবা-চাচারা।
সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০২ সালের ১১ মে হাতিয়ার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজাউল করিম জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘ঢালচরে ডেমপিয়ার অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম’ নামের কোনো ফার্ম অতীতে ছিল না, বর্তমানেও নেই।’ ২০০৮ সালে তৎকালীন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবদুল হক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘মনপুরার কামাল উদ্দিন চৌধুরী গং তথাকথিত জমিদারি প্রজাস্বত্বের দাবি করে চরডেমপিয়ার নামকরণে ধান কাটার মৌসুমে ঢালচরে আধিপত্য বিস্তার করে হাতিয়ার নিরীহ ভূমিহীন পরিবারগুলোকে প্রতারিত করে আসছেন। আসলে চরডেমপিয়ার বলতে কোনো মৌজার অস্তিত্ব নেই।
সচিব থাকা অবস্থায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আর জবরদখল করেই সরকারি জমিতে নিজেরা রাজত্ব করছেন আর ভূমিহীনদের অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করে যাচ্ছেন।
গত ৮ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ঢালচরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক মাছের খামার তৈরি করেছেন সাবেক সচিব নাজিম চৌধুরী। শত শত মহিষ, গরু ও ভেড়া-ছাগল চরছে মাঠে। ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, এস্ককাভেটর মেশিন দিয়ে প্রতিদিনই মাটি কেটে মাছের খামার বাড়ানো হচ্ছে। বন বিভাগের ম্যানগ্রোভ বনভূমি উজাড় করেও নতুন নতুন খামার গড়া হচ্ছে।
নাজিম চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের লাঠিয়াল বাহিনী আর জলদস্যুদের হামলায় এ পর্যন্ত ৩৭ জন ভূমিহীন নিহত হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে হাতিয়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এক প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ১১ উল্লেখ করেছেন।