পাওনারদের চেক দেয়ার পর পরই থানায় গিয়ে চেক হারানোর জিডি করত মহাপ্রতারক সাহেদ। এতে চেক ডিজনার হলে পাওনাদার আদালতে সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে উল্টো ফেঁসে যেতেন।
জিডি দেখিয়ে সাধু সেজে পাল্টা অভিযোগ করত, ওটা আমার হারানো চেক। সে পাওনাদার নয়, আমার হারানো চেক নিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য মামলা করেছে। এই দেখুন আমার চেক হারানোর জিডি।
বিজ্ঞ হাকিমের পক্ষে তখন আর নিঃশঙ্কোচে সাহেদের বিরুদ্ধে আদেশ দেয়ার উপায় কি? তদুপরি সাহেদ এ ধরনের চেক জালিয়াতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এ রকম বেশ ক’জন ভিকটিম চেক ডিজনার মামলা করে রায় পেলেও টাকা আদায় করতে পারেননি।
অন্যদিকে চেক জালিয়াতির মামলা করে উল্টো ফেঁসে গেছেন এমন ভিকটিমও কম নয়। এরকমই একজন ভিকটিম নারায়ণগঞ্জের মিঠু গাজী। র্যাব ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেছেন, আমার কর্মজীবনে এমন প্রতারক আর দেখিনি। এ ধরনের কাহিনীও শুনিনি। একদিকে চুরি অন্যদিকে সাধুগিরি।
ভিকটিম এখন র্যাবের কাছে আসছে। আমরা প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত করব। তার প্রতারণা দেখে আমরা হতবাক। বিশ্বাস করতে পারছি না, একজন মানুুষ কিভাবে সর্বস্তরে প্রতারণার নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারে।
আমরা মিঠুর মতো আরও কিছু ভিকটিমের সন্ধান পেয়েছি। একজন মানুষ কতটা শৈল্পিক প্রতারক হলে এভাবে পাওনাদারকে মিথ্যা মামলা করে ফাঁসাতে পারে তার বড় প্রমাণ মিঠু। তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার বিপরীতে চেক দিয়ে উল্টো তাকেই প্রথমে জিডি পরে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো এমন নিখুঁত প্রতারণা তো এর আগে কখনও দেখিনি।
এ ধরনের আরও বেশ ক’জন ভিকটিম আদালতে গিয়ে সাহেদ ও মাসুদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবে মামলার পর মামলায় তার জীবনের সব আমলনামা উঠে আসবে।
টাকা চাওয়ার পর প্রথমে চেক, তারপর মিথ্যা জিডি আমার বিরুদ্ধে। তারপর আমি আইনের আশ্রয় নিলে সাহেদ ও মাসুদ দুজনেই আমার বিরুদ্ধে ওই জিডি দিয়ে আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের। এর চেয়ে বড় প্রতারণা ও জালিয়াতি আর কি হতে পারে। এই প্রতারণার কঠোর শাস্তি হতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার আদর্শ কলোনির বাসিন্দা মিঠু গাজী একজন স্বনামধন্য ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী। ঘটনাক্রমে সাহেদের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে পরিচয় হয়। তখন সাহেদ তার ওয়ার্কশপ আরও বড় করার জন্য কিছু ভাল মেশিন সরবরাহের আশ্বাসে মিঠুর কাছ থেকে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা নগদ নিয়ে নেয়।
কিন্তু মিঠুকে মেশিন সরবরাহ করেনি। কয়েক মাস ঘুরানোর পর মিঠু মেশিনের পরিবর্তে পাওনা টাকা ফেরত চায়। বার বার টাকা চাওয়ার পর সাহেদ তাকে উত্তরার রিজেন্ট অফিসে আসতে বলেন। যথারীতি মিঠু হাজির হয়ে টাকা চাইলে তাকে সাহেদের পক্ষে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক সই করে দেয় রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজ। মিঠু হাফ ছেড়ে চলে যান নিজ বাসায়।
এদিকে সাহেদের পরামর্শে পরদিন অর্থাৎ ৬/১/২০২০ তারিখে মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে চেক হারানোর একটি জিডি করে। যার নং ৩৪৬। অন্যদিকে নির্ধারিত তারিখে মিঠু এমটিবি ব্যাংকে গিয়ে চেক জমা দেয়ার পর তা ডিজনার হয়। এভাবে বার বার চেক ডিজনার হওয়ার পর অনন্যোপায় হয়ে মিঠু নারায়ণগঞ্জের একটি আলাদতে গিয়ে গত ২৮/৬/১৬ তারিখে মামলা দায়ের করে সাহেদ ও মাসুদের বিরুদ্ধে। মামলা নং- ৪৬২/১৬।
ওই মামলায় যখন চার্জ হওয়ার জন্য শুনানি চলে তখন সাহেদ বুঝতে পারেন, তিনি ফেঁসে যাচ্ছেন। তখন তিনি গ্রহণ করেন মিথ্যা মামলা দায়েরের মতো পাল্টা কৌশল। তিনি গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার একটি আদালতে গিয়ে চেক হারানোর জিডি দিয়ে মিঠুর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করেন। এখন দুটো মামলাই চলছে। এভাবেই চলে সাহেদের চেক ডিজনার মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল হিসেবে জিডির কপি দিয়ে পাল্টা মামলা দায়ের করা। মিঠু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, কি ভয়ঙ্কর প্রতারকের কবলে পড়েছেন তিনি।
সাহেদ শুধু রিজেন্ট হাসপাতালের মাধ্যমে করোনা জালিয়াতির বিষয়ে স্বীকার করলেও অনেক অভিযোগ অস্বীকার করছে। এর আগে ডিবির হেফাজতে থাকার সময় নানা প্রতারণা, নারী ও টাকার বিনিময়ে প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করা সম্পর্কে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যের মধ্যেও কোন প্রতারণা রয়েছে কিনা তা পুনর্যাচাই করতে দুই সহযোগী মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীর মুখোমুখিও করা হয়। র্যাব সূত্র জানায়, রিজেন্টে হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার অনুমতি দিতে সাহেদ কি পরিমাণ অর্থ লেনদেন করেছেন তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে।
অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। এরপর ১৫ জুলাই বোরকা গায়ে নারী সেজে ভারতে পালানোর সময় সাতক্ষীরা দেবহাটা সীমান্ত এলাকায় তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে র্যাব। তাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে র্যাব থেকে পাঠানো হয় ডিবিতে। ওই মামলায় ডিবি ১০ দিনের রিমান্ড নিয়ে তাকে ও মাসুদসহ অন্যদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ৬ষ্ঠ দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে আবার র্যাবে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এখন র্যাব হেফাজতেই চলছে জিজ্ঞাসাবাদ।