“আমার বয়স একটু বেশী। তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পরতে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে।
আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরুপ সম্ভর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগযিবিশনে যাতে দোকান পাট যাতে না বসে। তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এই খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখনও হিন্দু, মুসলমান বলে জিনিস ছিল না। একসাথে গান, বাজনা, খেলাধুলা ও বেড়ান সবই চলত।” — শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা নং ১১ একজন ছাত্রের উপর দায়িত্ব পরল বাংলার দুই মন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্বর্ধনা আয়োজন করার। তাও আবার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
ছাত্রটি আর কেও নয়। শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু। শেরে বাংলা ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্বর্ধনা আয়োজন করার দায়িত্বের উপর দিয়েই ফুটে উঠে ছিল বাংলার আরেক নেতা আবির্ভাবের চিত্র। আলোয় আলোকিত করে জ্বলে উঠেছিল একজন কর্মনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিচ্ছবি। সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। টার্নিং পয়েন্ট এ কারণে যে – হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (তখনকার সময়ের শ্রমমন্ত্রী) সাথে সম্মুখ পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শুধু পরিচয় নয় পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর এলাকায় ( গোপালগঞ্জ ) মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের সংগঠক হিসাবে কাজ করার এবং কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক ও নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তাছাড়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা হচ্ছে – এই সম্বর্ধনার ঘটনার জের ধরেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা ও কারাবাসের ঘটনাটি ঘটেছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে যদি শেখ মুজিবুর রহমানের সেই দিন পরিচয় না হত তাহলে হয়ত পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে আমরা পেতাম না। হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই বঙ্গবন্ধু পেলেন রাজনীতির হাতে খরির পরিচয় পত্র।
দুই মন্ত্রীর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান ও বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবাসঃ- বাংলার দুই মন্ত্রীর সম্বর্ধনাকে কেন্দ্র করেই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবাসের সূত্রপাত ঘটেছিল। এই কারাবাসের মূল কারণ যদি একটু বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব – কি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্বের প্রতিফলন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে। যদিও দুই মুসলিম মন্ত্রীর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান এবং মুসলিম লীগের নেতা তারা সেহেতু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও হওয়া উচিত ছিল শুধুমাত্র মুসলমান ছাত্রদের নিয়ে।
কিন্তু শেখ মুজিব তা না করে হিন্দু ছাত্রদেরকেও তার দলে রেখেছিল। যদিও হিন্দু ছাত্ররা পরবর্তীতে তার দল ত্যাগ করেছিল কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের নির্দেশে। এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন না করার জন্য বহু ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করা গেছে। তারপরও সকল ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে শেখ মুজিব খুব দক্ষতার সাথে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু মূল ঘটনাটি ঘটে গেল অনুষ্ঠানের পরে। হিন্দুরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার জের ধরে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে রেশারেশি চলছিল। শেখ মুজিবের সহপাঠী আব্দুল মালেককে ধরে নিয়ে যায় হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জীর বাড়ীতে।
শেখ মুজিব খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ছুটে গেলেন সুরেন বাবুর বাড়ীতে এবং প্রথমে অনুরোধ করলেন তাতে কাজ না হওয়ায় শেখ মুজিবের কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এল “ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব”। যেমন কথা তেমন কাজ। সুরেন বাবুর বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে আব্দুল মালেককে ছিনিয়ে নিলেন মুজিব বাহিনী। এই যে শেখ মুজিবের বিপ্লবী কণ্ঠ “ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব”- তখন শেখ মুজিব অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। অতটুকু বয়সে তার বিপ্লবী চরিত্রের আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
পরবর্তীতে শেখ মুজিবের অনেক কর্মকান্ডে বিপ্লবী এমন কণ্ঠসুর শুনেছি আমরা যে গুলি ছিল বাঙালির বাংলাদেশ গঠনের মুল হাতিয়ার । সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি ছিল – এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা হল এবং জীবনের প্রথম কারাবাস হয়েছিল মাত্র সাত দিন এবং অর্থদণ্ড করা হলছিল পনেরশত টাকা।
শেখ মুজিবুর রহমানের এই প্রথম সাত দিনের কারাবরণ তার জীবনের একটি মাইলফলক হয়ে গেল। পরবর্তীতে সকল আন্দোলন সংগ্রামে ব্যাক্তি শেখ মুজিব থেকে রাজনৈতিক শেখ মুজিবে রপান্তর, ছাত্র নেতৃত্ব, কলেজ জীবনে একচেটিয়া ছাত্র রাজনীতির আধিপত্য ( কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ) সকল নেতৃস্থানীয় নেতাদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ, ( বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহার্দতা লাভ ) পাকিস্তান গঠনের তীব্র আন্দোলন সহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সাথে একাত্বতা বোধ ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার আদেশ, ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ, যুক্তফ্রন্ট সহ মহান মুক্তিযোদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী একমাত্র যাদুকর নেতা সৃষ্টির পুর্বাবাস পাওয়া গিয়েছিল সেদিনই, যেদিন প্রথম কারাবাসের কার্যকারণ গত উপলক্ষটি প্রতিভাস হয়েছিল। একজন রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছিল গোপালগঞ্জের কারা সেলে (১৯৩৮ইং সালে)। সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বমোট (চৌদ্দ) ১৪ বৎসর কারাজীবন কাটিয়েছিলেন। কারাগারই ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বাসগৃহ । এই কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন তার অমর সাহিত্য অসমাপ্ত আত্মজীবনী ।
তথ্য সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান