২১ আগষ্ট ২০০৪, মাহবুবের বেশ টেনশন লাগছে, তাঁর চারদিকে হাজার হাজার মানুষের জনসমুদ্র। জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত চারদিক। শেখ হাসিনা বক্তব্য শেষ করে সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল নিয়ে ৩২ নম্বর যাবেন। এতো বিশাল জন সমুদ্র ঠেলে কিভাবে নিয়ে যাবেন মাহবুব এখন সেটাই ভাবছেন। বেশ গরম লাগছে তাঁর, সদ্য অবসর নিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে। গরমের তোয়াক্কা করছেন না। মাথার ঘাম ভুরু পার হয়ে চোখে ঢুকে বেশ জ্বালাপোড়া করছে। মাহবুব বিকারহীন, সামান্যতেই অস্থির হওয়ার লোক সে নয়।
দুপুরবেলা ভাত খাওয়া হয় নি তাঁর, আজকে মেয়েটার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া কথা, কেমন করেছে কে জানে। বাসায় আজকে ভালোমন্দ রান্না হয়েছে। নেত্রীকে বাসায় পৌঁছে দিতে দিতে রাত হয়ে যাবে। মেয়ে বলেছে “বাবা তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু, মা পায়েশ রান্না করবে”। মাহবুব ভাবলো খাওয়া দাওয়া রাতে মেয়ের সাথে গিয়েই করা যাবে।
মাহবুবের বেশ টেনশন হচ্ছে, টেনশনে পায়ের তালু আর হাতের তালু ঘামছে। মনের অজান্তেই কোমরে হাত দিয়ে সাইড আর্মসটা ফিল করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হায়! আর্মস তো নেই। বেশ কিছুদিন ধরে আর্মসের পারমিশন চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেও সাড়া পায়নি মাহবুবসহ তাঁর বাকি সহকর্মীরা। আর্মস ছাড়া গার্ড দেয়া বেশ বিপদজনক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সবাই আনআর্মড। কেবল বুকে সাহস নিয়ে মাহবুবসহ সবাই গার্ড দিচ্ছেন।
বিকেল ৫:২২ মিনিট, নেত্রী বক্তৃতা শেষে মঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে নামবেন,চারদিক জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে মুখর। মাহবুব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সিঁড়ির কোনায়। শেষবারের মতো চোখের সামনে বিশাল জনসমুদ্রের দিকে মাহবুব তাকালো। নেত্রী ৫/৬ কদম হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নামবেন।
আরও পড়ুন… ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা: মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী
হঠাৎ দুমমমমমম! দুমমমমমমমমম! দুমমমমমমমমমমমম
মোট ১৩ বার! মাহবুব ঘুরে নেত্রীর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। বাম হাতটা নড়ছে না। নিশ্চয় নার্ভ বলে কিছু অস্তিত্ব নেই। শব্দ শুনে মাহবুব বুঝে গেলো শক্তিশালী নতুন মডেলের গ্রেনেড। আর্মড ফোর্সেসে থাকার সময় এসব দেখেনি। মাহবুবব ডান হাত দিয়ে নেত্রীর হাত টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে ফুটেছে আরো ৪ টা। কান শোঁ শোঁ করছে। নিশ্চয়ই পর্দাটার অস্তিত্ব বিলীন। বাঁ চোখে অন্ধকার দেখছেন। অপটিকাল নার্ভ স্প্লিন্টারে ছিন্নভিন্ন। সবাই মিলে নেত্রীকে ধরে গাড়িতে তুলে দিলেন।
হুশশশশশশশশশশ টাটা টা টা টা ট্যাররররররররররর করে আওয়াজ করতে করতে কি যেন কানের পাশ দিয়ে গাড়ির কাঁচে লাগলো। মাহবুব চমকে উঠলো। মাহবুবের দাঁত মুখ শক্ত হয়ে গেলো। ২/১ টা বুকে এসেও বিঁধেছে। মাহবুব চিনে ফেললো, রাইফেলটার ওজন ৪.৭৮ কেজি, ৬০০টা বুলেট একবারে ফায়ার করা যায় তাও ১ মিনিটে। ৪০.৬ ব্যারেল লেন্থ, প্রত্যেকটা বুলেটের ওজন ১২২ গ্রাম, বুলেটের ভ্যালোসিটি ২৩৩০ ফুট পার সেকেন্ড বা ৭১০ মিটার পার সেকেন্ড। ১০০ মিটার দূর থেকে ১৫ সেন্টিমিটারে যেকোনো টার্গেটে ফায়ার করা যায়। আর কার্টিজ হলো ৭.৬২*৩৯ মিলিমিটার। এক কথায় সাক্ষাত আজরাইল। রাইফেল টা হলো একে-৪৭।
আরও পড়ুন… সেই ভিক্ষুক কেঁদে বললেন; শেখ হাসিনা আরও ১০০ বছর বেঁচে থাকুক
এসব ভাবতে ভাবতে মাহবুবের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। ফুলহাতা শার্ট রক্তে ভেজা। মাহবুবের ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে, বাসায় গিয়ে ঘুমাবে।মাথা ঝিম মেরে উঠলো। মাথায়ও বুলেট ঢুকেছে, একে-৪৭ এর বুলেট। এক চোখে কিছুই দেখছে না।নেত্রীর গাড়ি বিদ্যুৎ বেগে ছুঁটছে, শেষ বুলেটটা ঘাড়ের পেছন দিয়ে ঢুকে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো। নেত্রীর গাড়ি সেইফ জোনে যাচ্ছে, তাকিয়ে মাহবুব একটা মুচকি হাসি দিলো।বিজয়ের মুচকি হাসি।
কাটা গাছের মতো ধড়াম করে পিচের রাস্তায় পড়ে গেলো মাহবুব। মেয়েটা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে, স্ত্রী পায়েস রান্না করছে, মেয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। মাহবুব শেষ হাসি হাসলো। এই হাসি বিজয়ের।
সূত্রঃ ডিফেন্স রিসার্চ ফোরাম।