“২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় প্যারাশুট রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সান্ধু সেদিন “স্পিয়ারহেড” বা অগ্রগামী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৫টায় তার কাছে একটি জরূরী আদেশ আসে।
একটি জরুরি কোড সক্রিয় করা হয়েছিল, এবং প্যারাট্রুপারদের অগ্রণী কোম্পানিগুলোকে দ্রুত মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়। একটি ব্যাটালিয়ন-স্তরের আক্রমণ বাহিনী ২৪/৭ জরুরি মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত থাকে এবং ভারতের জরুরী শক্তি প্রয়োগের কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে কাজ করে।
আগের রাতেও একটি অনুরূপ জরুরি কোড সক্রিয় করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তা বাতিল করা হয়। তবে, যখন আদেশ আবার আসে এবং তার সঙ্গে “পাঁচ বা ছয়টি” আইএল-৭৬ ও এএন-৩২ সামরিক বিমান প্রস্তুত করা হয়, তখন সান্ধু বুঝতে পারলেন যে এবার কিছু বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে।
দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে ১,০০০-এরও বেশি ভারতীয় প্যারা ট্রুপার পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটিতে উপস্থিত হয়। সেখানে রাতের জন্য অবস্থান নেওয়ার পর সান্ধুর কমান্ডিং অফিসার নির্দেশনা দেন।
বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), যা বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পরিচিত, তাদের সিপহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল এবং তারা বাংলাদেশি সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করছিল।
সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করছিলেন, হুমকির সম্মুখীন বোধ করছিলেন এবং সেনাবাহিনীর সহায়তার উপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না।
“তিনি ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন… আর সে কারণেই আমরা সেখানে ছিলাম,” স্মরণ করেন সান্ধু। সৈন্যরা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল এবং ঢাকায় নামার পর সম্ভাব্য সকল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন ছিল ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে, কারণ সংঘাত তীব্র হলে তারা হামলার শিকার হতে পারতেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা তখনো চলছিল। হত্যাকাণ্ড শুরুর কিছুক্ষণ পরেই হাসিনা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত শীর্ষ কংগ্রেস নেতা ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে ফোন করেন।
ঘটনা শুনে মুখার্জি প্রতিশ্রুতি দেন যে ভারত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাবে। ঢাকার “SOS” বার্তার পর ভারতীয় প্যারা ট্রুপারদের মোতায়েন শুরু হয় এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন হাসিনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও চীনের কূটনীতিকদের সঙ্গে জরুরি কূটনৈতিক যোগাযোগ করেন।
শুধু কলাইকুন্ডা নয়, জোরহাট ও আগরতলায়ও প্যারা ট্রুপার মোতায়েন করা হয়। যদি নির্দেশ আসত, তবে ভারতীয় বাহিনী তিন দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। মূল লক্ষ্য ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (পরবর্তীতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) এবং তেজগাঁও বিমানবন্দর দখল করা।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে প্যারা ট্রুপাররা গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিত এবং শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নিত।
অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ব্রিগেড কমান্ডার সরাসরি লড়াইয়ের জন্য নির্ধারিত “ফার্স্ট লাইন” গোলাবারুদ বিতরণ শুরু করেন। এটি ছিল “অত্যন্ত অস্বাভাবিক” একটি পদক্ষেপ, যা পরিস্থিতির গুরুত্বকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ছিল। যদি বাংলাদেশি জেনারেলরা হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, তবে তারা ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলত। “যদি তা ঘটত, তাহলে আমাদের পূর্বাঞ্চলে পুরো একটি কোর প্রস্তুত ছিল,” যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দ্রুত সেনা পাঠাতে পারত, বলেন মেজর সান্ধু।
২০০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারত বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের দ্বারপ্রান্তে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আদেশ আসেনি।
ঢাকায় ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার (২০০৭-১০) পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, যার পারিবারিক শেকড় বাংলাদেশে, শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধাসূচকভাবে “আপা” বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলেন, “আমরা কিছু বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছিলাম এবং হাসিনাকে জানিয়েছিলাম যে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।” কেন? কারণ ভারত জানত না এই বিদ্রোহ কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ঢাকায় বিদ্রোহীরা পিলখানায় অবস্থিত বিডিআর সদর দপ্তরে তাদের মহাপরিচালক এবং তার স্ত্রীকে হত্যা করে, যা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় সেনা অফিসারদের ওপর আক্রমণের সূত্রপাত ঘটায়।
সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমেদের ওপর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ ছিল। তবে, তিনি যদি সামরিক পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে ব্যাপক রক্তপাত ও চরম অস্থিতিশীলতা দেখা দিত, যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিতে ফেলত। বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করতে পারত, ক্ষুব্ধ সামরিক কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারত, অথবা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারত।
ভারত কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি, তাই তারা মনে করেছিল যে যা প্রয়োজন তাই করতে হবে। তারা সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়।
“আমি যাদের কাছ থেকে ক্ষমতার নিকটবর্তী তথ্য পেয়েছি, তারা বলেছিলেন যে জেনারেল মইনকে সতর্ক করা হয়েছিল যে তিনি যদি শক্তি ব্যবহার করেন, তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যে [ভারতীয়] প্যারা ট্রুপাররা ঢাকায় নামবে,” বলেন তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসাইন (যিনি বর্তমানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা)।
ভারত কোনো ধোকাবাজি করেনি। “সবকিছু বাস্তব ছিল … যদি প্রয়োজন হতো, আমরা অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতাম,” নিশ্চিত করেন ভারতের এক শীর্ষ কর্মকর্তা, যিনি তৎকালীন পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই আদেশ আসেনি, কারণ মইন শেষ মুহূর্তে পিছু হটেছিলেন।
“প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন যে এই সংকট রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান করতে হবে এবং সেইভাবেই এটি সমাধান করা হয়েছে,” ঘোষণা করেন তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ হোসেন।”
উপরের এই বিবরণটি “India’s Near East: A New History” বই থেকে নেয়া। যেখানে বিষয়টি সম্পর্কে প্রায় সকল জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সত্য ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিডিআর বিদ্রোহ এবং সেখানে ঘটা নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে এই হত্যাকান্ডের পেছনের কারিগরেরা এখনও মিথ্যা বলে চলেছে। তারা যত মিথ্যা বলে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি মিথ্যা হল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তকর্তা বিশেষ করে তখনকার সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে নিয়ে। সামরিক বাহিনীর ৫৭ কর্মকর্তা এবং আরো ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তির নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে অশিক্ষিত এইসব প্রোপাগান্ডাকারী খুনিদেরই দোসর। তাদের ক্ষোভ যে ঐ ঘটনায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে তারা যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারকে চেয়েছিল সেটা বিফল করে দিয়েছিল শেখ হাসিনার সাহস, ভারতের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসা এবং তখনকার সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের মাথা ঠান্ডা রাখা।
কেন ভারত প্রতিবেশী দেশ সৈন্য পাটানোর মত এত বড় ঝুঁকি নিতে চেয়েছিল। সেই প্রশ্নের উত্তর ভারতীয় প্যারাশুট রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সান্ধু দিতে পারবেন না। পিলখানায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করার আগের দিন কসাই ভাড়া করে আনা হয়েছিল। নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের এমনকি গৃহপরিচারীকাও বাদ যায়নি।
দরবার হলে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বিদ্রোহী জওয়ানদের একটি দল বিডিআরের তত্কালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বাসায় ঢুকে পড়ে। তাদের দেখে শাকিলের স্ত্রী নাজনীন আহমেদ ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। তখন কয়েকজন সৈনিক নাজনীনকে টেনে বের করে নির্যাতন করেন এবং এক পর্যায়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন। বিদ্রোহীরা মহাপরিচালকের বাসার ১২ বছর বয়সী একটি কাজের মেয়েকেও নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করেন।
জওয়ানেরা মহাপরিচালকের স্ত্রীকে হত্যার পর দোতলায় উঠে ওই বাসার অতিথি মহাপরিচালকের বন্ধু লে. কর্নেল (অব.) দেলোয়ার ও তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেন। সেনা তদন্ত আদালতের (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) প্রতিবেদনে বলা হয়, তত্কালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিলসহ অন্য কর্মকর্তার স্ত্রীদের হত্যা ও নির্যাতন করার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত। কোন কোন কর্মকর্তার স্ত্রীকে মারধর করা হবে, তাও আগে থেকে নির্দিষ্ট করা ছিল। বিদ্রোহের সূচনাতেই নির্দিষ্টসংখ্যক বিডিআর-সদস্য বেছে বেছে পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি বাসায় গিয়ে কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর করেন।
বিডিআর বিদ্রোহ এবং হত্যাকান্ডের এই সব সিগনেচার বলে দেয় বিদ্রোহটি ছিল কাভার আপ মাত্র, আসল উদ্দেশ্য ছিল গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে সারা দেশে স্বাধীনতার পক্ষের সেনা কর্মকর্তারা, তাদের পরিবার, এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতিবীদ ও সমর্থকদের নির্বিচার হত্যা করা। তারা সারা দেশে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েই শুধু সামরিক বাহিনীর আক্রমণ শুরুর সংকেতের অপেক্ষা করছিল। শেখ হসিনা বিষয়টা বুঝেছিলেন, বুঝেছিল ভারতের উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা ও সমর নীতি নির্ধারকেরা। তাই তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ও দেশের জনগণকে রক্ষার জন্যই।
লেখক: সিরাজুল হোসেন