সিরাজুর রহমান: করোনা (কভিড-১৯) ভাইরাসের ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী থাবায় আজ চরমভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিশ্ব সমাজ ও তার অর্থনীতি। তবে বৈশ্বিক মহামন্দা চলা সত্ত্বেও ২০২০ সালের ২০ জুলাই ভারতের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫১৩.২৫ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা ভারতের ইতিহাসে এটি রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সর্বোচ্চ রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের এখন বৈদেশিক মুদ্রার সম্পদের (এফসিএ) পরিমাণ ৪৭৩.২৬ বিলিয়ন ডলার এবং সোনার রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ৩৪.০৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে করোনা (কভিড-১৯) ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এবং বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনীতির মহামন্দা চলাকালীন অবস্থায় ভারতের সমষ্টিক অর্থনীতির জন্য ৫১৩.২৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের এই বিপুল পরিমাণে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি এ রিজার্ভ নতুন শিল্প এবং কল-কারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগের মাধম্যে নতুন কর্ম সংস্থান সৃষ্টি এবং তার পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির উপায় নির্ধারণের উপর নির্ভর করবে দেশের ইতিবাচক এবং স্থিতশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ।
তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, উন্নয়নশীল এবং রপ্তানি নির্ভর অর্থনৈতির দেশে হঠাত করে আমদানি ব্যাপক মাত্রায় কমে গেলে এবং নতুন করে শিল্প উন্নয়ন এবং স্থাপনের হার হ্রাস পেলে সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ফরেন কারেন্সির পরিমাণ ও মজুত বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিমাণে রেমিটেন্স প্রবাহ বিদ্যামান থাকায় তা প্রতি নিয়ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, করোন ভাইরাস মহামারীর কারণে ভারতে রেমিট্যান্স প্রবাহ গত ২০১৯ সালে ৮৩.০০ বিলিয়ন থেকে চলতি ২০২০ সালে ২৩% হ্রাস পেয়ে ৬৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে। যেখানে ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতের প্রবাসী কর্মীরা ৬২.৭০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। যা ২০১৭ সালে ছিল ৬৫.৩০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে তা ৭৯.০০ বিলিয়ন ডালারে পৌছে যায়। আর এই ব্যাপক আকারের রেমিট্যান্স প্রবাহ কার্যত দীর্ঘ দিন থেকেই ভারতের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তাই যে কোন কারণে ভবিষ্যতে অভারসীজ ইনকাম বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হলে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের উপর ব্যাপক চাপ পড়তে বাধ্য।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারতের ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সামগ্রিক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩১৪.৩১ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের তুলনায় ভারতের রপ্তানি কমেছে কমেছে প্রায় ১৪%। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৩০.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছিল ৩০৩.০০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে অবশ্য মোট আমদানির পরিমাণও কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৯.১২% কমে ৪৬৭.১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। যার ফলে ভারতের এই সময়ের মধ্যে বানিজ্য ঘাতটির পরিমাণ বা স্থিতি ১৮৪.১৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অবশ্য ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ভারতের মোট রপ্তানি ছিল ৩০৩.৫ বিলিয়ন ডলার এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ রপ্তানির রেকর্ডটি হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৩১৪.৪০ বিলিয়ন ডলার।
২০২০ অর্থ বছরে চীন থেকে ভারতের আমদানি মোট ৬৫.১০ বিলিয়ন ডলার এবং রফতানি হয়েছে ১৬.৬০ বিলিয়ন ডলার। তবে জুন ২০২০ এ ভারতের পন্য রপ্তানি ১২.৪০% কমলেও দেশটির আমদানি ব্যয় কমেছে ৪৭.৬%। যার ফলে দেশটি ১৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম বারের মতো ৭৯০ মিলিয়ন ডলার বানিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
তাছাড়া ৩০শে জুন ২০২০ অনুযায়ী ভারতের বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ কিছুটা কমে এসে ৫৫৮.৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা কিনা ৩১শে ২০২০ এ ছিল ৫৬৩.৯০ বিলিয়ন ডলার। তবে বৈদেশিক ঋনের সুদের পরিমাণ যদি বার্ষিক মাত্র ৪% ধরা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ভারতকে প্রতি বছর আনুমানিক গড়ে ২০.০০ বিলিয়ন ডলার শুধুমাত্র ঋনের সুদ বাবদ সমপরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় বিভিন্ন দেশ এবং আইএমএফ, এডিবি, জাইকা বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক বৈশ্বিক ঋন প্রদানকারী সংস্থাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা কিন্তু একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য অত্যন্ত চিন্তার একটি বিষয় এবং যা অবশ্যই ভারতের সমষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য মোটেও সুখবর কিছু নয়। যে ভাবেই হোক বৈদেশিক ঋনের বোঝা আস্তে আস্তে কমিয়ে নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্বের বর্তমান উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের ২০১৯ সালে রপ্তানির পরিমান ২.৪৯৯ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২৪৯৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০১৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২.৪৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এদিকে বিশ্বের প্রথম স্থানীয় সামরিক ও অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.৬৪৫ ট্রিলিয়ন বা ১৬৪৫ বিলিয়ন ডলার এবং তা কিন্তু ২০১৮ সাল অপেক্ষা ১.২০% কম।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় আটটি দেশের মধ্যে বৈদেশিক ঋনের বিবেচনায় সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে ভারতের চীর বৈরি দেশ পাকিস্তান। ৩১শে মার্চ ২০২০ অনুযায়ী পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ১১২.০০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মার্চ ২০২০ এর হিসেব অনুযায়ী মাত্র ১২.০৪ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক রপ্তানির পরিমাণ ২৪.২২ বিলিয়ন ডলার। যা দেশটির বিশাল আকারের বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিবেচনায় অতি নগণ্য বলেই প্রতিয়মান হয়।
৩০শে জুন ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬.১৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ প্রায় ৩৫.০০ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এসব ঋণ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ইআরডি সূত্র জানায়, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ক্রেডিট রেটিংও ভালো।
এদিকে ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনৈতি যখন টালমাটাল অবস্থা, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে লন্ডন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট। ৬৬টি দেশের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানটির এক জরিপে সুরক্ষিত অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম স্থানে, ভারতের অবস্থান ১৮তম, পাকিস্তানের ৪৩তম এবং শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬১তম স্থানে রয়েছে। মুলত দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বিপরীতে সরকারি দেনার পরিমাণ, মোট বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণের সুদ ও অন্যান্য খরচকে আমলে নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছিল।