জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের শেষ দিনগুলো তাঁর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলেন। মহান এই নেতা সারাজীবন দেশের সাধারণ জনসাধারণের কল্যাণ চিন্তা করেছেন, আর তাদের মাঝে নিজেকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই, জীবনের শেষ দিনগুলোতে গ্রামের নিঝুম প্রকৃতির কাছেই থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।
বড় সন্তান হিসেবে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও ইচ্ছের কথাও তাই মেয়ের সঙ্গেই আলাপ করতেন। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘বাবার কাছাকাছি বেশি সময় কাটাতাম। তাঁর জীবনের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক আলোচনা করার সুযোগও পেতাম।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থের ‘স্মৃতির দখিনা দুয়ার’ আত্মকথনে তিনি জাতির জনকের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তাঁর একটি কথা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘শেষ জীবনে আমি গ্রামে থাকব। তুই আমাকে দেখবি। আমি তোর কাছেই থাকব।’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম আঘাতে তিনি স্বপরিবারে নিহত হন। এর মাত্র ১৬ দিন আগে ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানা এবং দুই শিশু সন্তান সজিব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে জার্মানিতে কর্মরত পরমাণু বিজ্ঞানী স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কাছে চলে যান। শেখ হাসিনা সেদিন যেতে চাননি।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিলো সমাবর্তনের প্রস্তুতি। ১৫ আগস্ট এ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাজ সাজ রব। জার্মানি যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসময়ের উপাচার্য পদার্থবিদ ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর সাথে দেখা করতে যান। আবদুল মতিন চৌধুরী সেদিন শেখ হাসিনাকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত থেকে যেতে বলেন। ঐতিহাসিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানের অংশীদার হতে। শেখ হাসিনাও থেকে যাওয়ারই মনস্থ করেন। কিন্তু ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার টেলিফোন পেয়ে ৩০ জুলাই তারিখেই চলে যান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেদিন যদি স্যারের কথা অমান্য না করে ঢাকায় থেকে যেতাম, আমার জন্য সেটাই ভালো হত।… মা, বাবা, ভাইদের সাথে যদি আমিও চলে যেতে পারতাম, তবে প্রতিদিনের এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে তো বেঁচে যেতাম।’
১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই দুই মেয়ের বিদায়কালে বঙ্গবন্ধুও খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি দিনের প্রতিটি কাজের সাক্ষী। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। এমনভাবে তাঁকে আর কখনো কাঁদতে দেখিনি।’
সেদিন যদি শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা জার্মানি চলে না যেতেন তাহলে হয়তো জীবনের শেষ দিনগুলো বঙ্গবন্ধু বড় মেয়ের সান্নিধ্য পেতেন। কিন্তু বাঙালী জাতির জীবনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে বিলীন হয়ে যেত।
ড. ফরাসউদ্দিন এই চলে যাওয়াকে ‘দৈব সৌভাগ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন বাংলাদেশ থেকে চলে না গেলে তারাও হয়তো এই নির্মমতার শিকার হতেন। আর আমরাও আজকের এই বাংলাদেশ পেতাম না।’
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। একটি স্বাধীন, শিক্ষিত ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে তিনি যেসব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, যে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তার সবই স্তব্ধ করে দিয়েছিল ঘাতকের নির্মম বুলেট।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু সব মিলিয়ে প্রায় এগারো বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের জন্যই তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় দিয়েছেন। কিন্তু পাঁচ সন্তানের জনক এই মহান নেতা সন্তানদের মধ্যেও প্রোথিত করেছিলেন উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনা। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন পূরণে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।
কিন্তু শেখ হাসিনা পিতার অন্তিম ইচ্ছের কথা কখনও ভোলেন না। তাইতো যতদূরে যেখানেই যান, টুঙ্গীপাড়ার ছায়াঢাকা শীতল গ্রামখানি তাকে হাতছানি দেয়। তিনি ও জীবনের শেষদিনগুলো পিতার স্নেহ ছায়ায় কাটাতে চান। ‘স্মৃতির দখিন দুয়ারে’ তিনি বলেন, ‘গ্রামের নিঝুম পরিবেশে বাবার মাজারের এই পিছুটান আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমাকে বার বার গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।… আমার জীবনের শেষ দিনগুলোও আমি টুঙ্গিপাড়ায় স্থায়ীভাবে কাটাতে চাই। খুব ইচ্ছে আছে নদীর ধারে একটি ঘর তৈরি করার।’