নজরুল ইসলাম তোফা: ‘বাংলাদেশ’ ষড়ঋতুর দেশ। এ শীত ঋতু ষড়ঋতুর একটি ঋতু। আর এমন পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রকৃতির পরিবর্তন হয়। তাইতো বাংলার ঘরে ঘরে বারবারই ফিরে আসে- ‘শীত’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতনের দেশ-বাংলাদেশ। ষড় ঋতুর এই দেশে প্রত্যেকটি ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। ‘পৌষ এবং মাঘ মাস’- শীত কাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকেই শীতের সূচনা হতে থাকে। এমন শীতের আগমন পত্র কুঞ্জে, জলে-স্থলে সর্বত্রই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আসলে হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পরে আসে জড়তা গ্রস্ত শীত ঋতুর নির্মম বার্ধক্য। শুষ্ককাঠিন্য ও রিক্ততার বিষাদময় প্রতিমূর্তি রূপেই শীত আবির্ভাব ঘটে। তবুও শীতকালের প্রকৃতি ও মানুষের পরিবর্তনের বাস্তব লীলা অনেকেরই ভালো লাগে। বলা যায় যে, কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতমনা মানুষের কাছে শীত কাল কাব্য সৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলতেই হয় যে, বিশ্বের যত মনোরম দৃশ্যের স্থান আছে, সেই গুলোর মধ্যে শীত প্রধান স্থান-ই বেশি। তাই শীতল সেই সকল এলাকা অনেকেরই মন ছুঁয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ দেশেও শীতকালীন আবহাওয়া অনেকের খুব পছন্দ। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলের মানুষ শীত কালের এমন সময়, আলাদা প্রশান্তির আমেজেই থাকে। শীতের রাত্রিটা দীর্ঘ হওয়ায় তীব্র ঠান্ডায় নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি থাকে। প্রকৃতির মাঝ হতে মানুষ ঘরে ফিরেই যেন সারারাত্রীতে কম্বল, লেপ কিংবা কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে গভীর তন্দ্রায় যায়। খুব ভোর বেলায় ঘনকুয়াশার ধবল চাদরে প্রকৃতি ঢাকা থাকে। তখন হিমেল হাওয়ায় ‘হাড় কাঁপানি শীত’ জেঁকে বসলেও যেন- শীতের দাপট কাটিয়ে ওঠার জন্যেই মানুষজন সাধ্য মতো দামি দামি শীতবস্ত্র শরীরে জড়িয়েই প্রকৃতি নীরবতাকে উপভোগ করে। তার পাশা পাশি সব শ্রেণীর মানুষ নিজ ত্বকের যত্নশীল হয়। অবশ্য পরিবেশ গত কারণেই বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকে ইতিবাচকভাবেই দেখে।
শীতকালে এই দেশের বেশ কিছু গাছে ফুল ফুটে যেমন, গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ প্রভৃতি ফুল শোভাবর্ধন করে থাকে। ফুলের দোকান গুলোতে বাহারি ফুলে ভরে যায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে নানা ফুলের দোকানগুলোতে নানা রকম ফুলের ডালি, তোড়া কিংবা মালাসহ সুসজ্জিত ফুলের উপকরণ বিক্রি এবং কেনার হিড়িক পড়ে যায়। শীতকালে বিভিন্ন সবজির পাশাপাশি খেঁজুর গাছের মিষ্টি রস, নানান পিঠাসহ হরেক রকমের সু-স্বাদু খাবার অন্য সময় দেখা দায়। তাছাড়া ধান ক্ষেত বা শাকসবজির ওপরে টলমল করা শিশির বিন্দু, সূর্যের সোনালি রশ্মিতে একপ্রকার মুক্তার মতোই যেন ঝলমল করে। শীতকালের বহু শাকসবজিতে ক্ষেত খামার ভরে যায়। শিম, লাউ, টমেটো, লালশাক,শালগম, পালংশাক, বরবটি, গাজর এবং মুলাসহ নানা রকমের শাক সবজি প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে। যা অবশ্যই এই বাংলাদেশের মানুষেরই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। বাংলার মানুষকে আকৃষ্ট করা বিভিন্ন ধরনের ফলনশীল ফসল, শাকসবজি আর সুস্বাদু পিঠা মেলার আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়।
সরিষা ফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য মনকে খুব পুলকিত করে। আহা!! কি আনন্দ আকাশে- বাতাসে! শীতে শিশিরভেজা বনেজঙ্গলে মধু পিয়ে নেচে পাপিয়ারা পিয়া পিয়া বলে ডাকে গুনগুন করে এক দল মৌমাছি, মহুয়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে। কতোই মধুর সুরে কতো পাখিরা গায়; কতো না রঙিন ফুলের ডালে ডালে, বাঁশবনে ডাকে আপন খেয়ালে ঝুঁটিবাঁধা হরিয়ালী। তাই অরূপ রূপের এই শীতে কালকেই বাংলার ‘রূপের রানী’ বললে ভুল হবে না। গ্রামাঞ্চলে সূর্যোদয়ের দেখা পেলেই গোসলের আগে ও পরে খাঁটি সরিষা তেল শরীরে মেখে দুপুরের কাঁচা রোদে বসে কেউ মজার গল্প করে কেউবা বিভিন্ন বই পড়েই বিনোদন করে থাকে। আবার বিকেলে নদী,খাল, বিল ও দীঘির পারে বসে আড্ডা দিয়ে থাকে।স্থির জলের উপর বিকেল বেলার সেই ঢলে পড়া সূর্যের মৃদু আলোর প্রতিচ্ছবি দেখার মজাই আলাদা। তারপর আস্তে আস্তে কুয়াশার চাদর নেমে আসে।
শীতের সকালে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষদের কন কনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শীতকালে মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে আসে। হাড় কাঁপানো তীব্র শীত গ্রাম বাংলার মানুষ-জীবজন্তুর সহিত প্রকৃতি অসাড় হয়ে পড়ে। এমন শীতের হাত থেকে হত-দরিদ্র মানুষ বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাদের সাধ্যমত শীতবস্ত্র কেনারও ধুম পড়ে যায়। শীতের সকালে ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। শীতের সকালে শহর এবং গ্রামে শিশু, যুবক বা বৃদ্ধ সহ সব বয়সের মানুষকে যেন আগুনের কুন্ডলী তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায়। এ আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে আলাদা এক অনুভূতি।
অনেক দেরিতেই ওঠে সূর্য। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। তাই তো মনে হয়, সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। শীত মৌসুমে ফসল তোলা মাঠ যেন দিগন্তব্যাপী সীমাহীন এক শূন্যতা বিরাজ করে। আসলে ভালো আর মন্দের সমন্বয়েই যেন এই শীত। সুতরাং এই শীতের সকালেই কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশাতে সব কিছু জড় সড় হয়ে আসে, সামনের কোনো কিছুই ঠিক মতো দেখা যায় না, সব কিছু যেন খুব অস্পষ্ট মনে হয়।কখনো কখনো কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে যে, দেখলে মনে হয় সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো এলাকায় ঘন কুয়াশার সঙ্গেও ঝিরিঝিরি শিশির বিন্দুর অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য মামার উঁকি দেয়া প্রাকৃতির রঙিনতা আবহমান বাংলার সকল জনপদ রাঙিয়ে তোলে। রাস্তায় গাড়ি গুলো চলে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তারমধ্যেই যেন শীতের রংবেরঙের বিভিন্ন পোশাক গায়ে জড়িয়েই মানুষ ছুটে চলে কাজের নিমিত্তে নিজ গন্তব্যে।
সকালে উঠে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় শিশু কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সহ সবাই যেন উসখুস হয়ে থাকে। চায়ের দোকান গুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। শীতে শহরের বিভিন্ন রকমের দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তাছাড়াও গ্রামে প্রচণ্ড শীতের মাঝে সকল শ্রেণীর মানুষ চা খায়। কাক-ডাকা ভোরের সময় শহর এবং গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে। কনকনে শীতের সকালে শহর ও গ্রামের রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান বা স্টলে বাহারি রঙের দেশী-বিদেশী নামি দামি ‘ড্রেস’ পরে জমজমাট আড্ডায় কোলাহল মুখর থাকে। খুব সকালে যখন যুবক ও শিশুরা চা বা গরম দুধ খায়, ঠিক তখনই তাদের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। এই ধোঁয়া বাহির করে। তারা খুব মজা করে। বন্ধুদের কাছে বলে,- সবাই দেখো বিড়ি খাচ্ছি , তাই তো এমন এই ধোঁয়া! এমন দুষ্টামি তো শীতেই মানায়। শীতে কুয়াশা ভেজা নরম প্রকৃতি কিংবা মানুষের মধ্যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
বলা দরকার যে কিষকের বউ মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে সুনিপন হাতে ভাপাপিঠা তৈরি করে, আতপ চাল নারিকেল বা গুড়ের গন্ধে গরম ধোঁয়া উঠা সু-স্বাদু পিঠা একেকবারই একেক জনের হাতে পরিবেশন করার দৃশ্য শীত ঋতু না আসলে সম্ভব নয়। এ যেন একটি চিরায়াত গ্রামবাংলার চিরচেনা শীতের সময়ের পরম মমতা এবং ভালবাসার ছবি। শৈশবে বা কৈশোরে নিজ গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণীর মানুষের এক আলাদা অনুভূতি। তাই এই শীতের সকালের ‘মিষ্টি রোদে’ ছেলে মেয়েরা চিড়া-মুড়ি- খেজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতেই যেন রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনে বেলা খুব ছোট হওয়ার জন্যে বেলা মাথার ওপর আসতে আসতেই যেন সন্ধ্যা হয়। এ সময়ে শীতের তীব্র দাপট থেকে বাঁচতে সকল মানুষ- জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার এবং কোট সহ রংবেরঙের বাহারি শীতবস্ত্র পরিধান করে। সাজপোশাকেও আসে বৈচিত্র্য। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্রামের দিকে দৃষ্টি দিলেই শীতের বিশুদ্ধ অনুভূতি ভালো ভাবেই পরিলিক্ষত। গ্রামে ছেলে মেয়েরা তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে, ব্রাশ করতে করতে বাড়ির আশপাশ ঘোরাফেরাও করে। বলা যায় বেশিরভাগ দিনেই যেন কুয়াশার চাদরে আবৃত করে রাখে গ্রামাঞ্চল। ঘাসের আগায় বিন্দু বিন্দু শিশির কনা যেন- মুক্তার মতোই চকচক করে। কোথাও ঘাসের মধ্যে হওয়া ছোট্ট মাকড়সার জাল গুলি অনেক শিশিরের স্পর্শেই যেন ‘হীরক খচিত’ জালের মতো মনে হয়। ঘাসের শিশির ফোঁটাগুলো নিজ পায়ে মাখাতে এক অনাবিল আনন্দ।
এদের বয়সটা কম তাই প্রত্যেক শীতের বিকেল ও সন্ধ্যা বেলায় নিজের পালুই থেকে কিংবা অন্যের পালুই থেকে খড় টেনে বের করে বা শুকনো খট-খটে মাঠের বড় বড় নাড়া ছিঁড়ে জড়ো করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে মজা পেত। সূয্যিমামা ওঠার আগে ও পাটে যাবার বেলা হালকা হালকা যখন হিম পড়া শুরু করে, মাঠের জমির সবুজ শাক-সবজির উপরে দিনের সূর্য ওঠার মূহুর্তে বা শেষবেলার আলো ঢলে পড়লে সেই মুহূর্তেই- তারা যেন খড়-কুটোতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে লকলক করে ওঠা- ‘আগুনের শিখার তাপ’ যেন নিজ গায়ে মাখতো। তারা ছাইয়ের সে শেষ রক্তিম অঙ্গারটুকু টুপ করে নিভে যায়, তখন হাত ধরাধরি করে হইহই করতে করতে বাড়ি ফিরে। শীতকালে পিকনিকও করে পাড়া-প্রতিবেশীর শিশু-কিশোরা বাড়ির আঙিনায় কিংবা ফাঁকা মাঠে। এই বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান এবং পিকনিক স্পট গুলোতে শীতকালেই ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষাসফর শুরু হয়। তা ছাড়াও গ্রামের হাট-বাজারে বা উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।
শীতের সময়ে গ্রামের খেতে খেতে ধান কাটাও শুরু হয়। পাকা ধানের সোনালি খেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পরপর কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তা যেন বাংলার চরম নান্দনিকতা। কুয়াশাচ্ছন্ন তীব্র শীতের সকালে এই দেশের কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে গরুসহ মাঠে যায়। যদিও এই দৃশ্য আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না, তবুও কিছু এলাকাতে আজও দেশীয় গরু ও লাঙল দিয়ে চাষাবাদ হয় বলেই বাংলার সৌন্দর্য ফুটে উঠে। এ বাংলায় কৃষক সৌন্দর্যের প্রতীক। তারাই কনকনে শীতে বোরো বীজ তলা, সদ্য রোপা এবং বোরো আবাদ রক্ষা করায় সকাল-বিকালেই অনেক ঠান্ডা পানি উত্তোলন বা পরিবর্তন করে। তাদের শ্রমের তুলনা হয়না, শীতের হাত থেকে ক্ষেতরক্ষা এবং পরিচর্যায় কঠিন বাস্তবতা সত্যিই যেন প্রশংসনীয়। শীত মানেই- “কুয়াশা আর শৈত্য প্রবাহ সহ তীব্র ঠান্ডা”। দুচোখ বন্ধ করলেই মনের পর্দায় ভেসে উঠে হাড়কনকনে শীতে জবুথুবু একটি গ্রামের ভোর। এ দৃশ্যপট বাৎসরিক ক্যালেন্ডারের পাতায় না থাকলে যেন ক্যালেন্ডারের পরিপূর্ণতাই পায়না। শীতের শিশির ভেজা ভোরের দৃশ্য আহা কি অপরূ, উদীয়মান সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত গ্রামীণ বাড়ির উঠোন। চাদর মুড়ি দেয়া মানুষ, নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি ধোঁয়াশা উজ্জ্বল, নরম এবং কোমলতায় ভরা প্রকৃতি। চিত্রশিল্পীরা শীতের প্রকৃতি ছবি আঁকতেও ভালোবাসে। জলরং চিত্র আসলেই যেন শীতের সকালে খুব ভালো হয়। গাম্ভীর্যময় বৈশিষ্ট্যের জন্যই যেন শীতের সকাল বছরের অন্যান্য ঋতুর সকাল থেকে স্বতন্ত্র। কবি সুকান্ত বলেন, শীতের সকাল/ দরিদ্রের বস্ত্রের আকাল/শীতের সকাল/অসাম্যের কাল/ধনীরসুখ আর আনন্দ/শ্রেণি সংগ্রাম এ নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব।
নিম্ন আয়ের বা অসহায়-দুস্থ মানুষের জীবনযাত্রা শীতে কাহিল হতেও দেখা যায়। তবুও জামাই আদর করতেই শীতেঋতুকে বেছে নিয়ে সুস্বাদু রসের পিঠা তৈরি করে। বাড়ী ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। সুতরাং এটিই হলো শীতকালীন এক উল্লেখযোগ্য বাংলার ঐতিহ্য। শীতে গ্রাম শহরে বলা যায় সব খানেই যেন চলে শীতকে ঘিরে নবান্নের উৎসব। এই শীতকালে মেলা সহ সর্বত্রই নানা রকম পিঠা তৈরি হয়। এমন দেশে ১৫০ বা তারও বেশি রকমের পিঠা থাকলেও মোটামুটি প্রায় তিরিশ প্রকারের সুস্বাদু পিঠার প্রচলন অনেকাংশে লক্ষ্যনীয়। তা ছাড়া আরও কতো রকমারি পিঠা অঞ্চল ভেদে রয়েছে সেই গুলোর নাম বলে শেষ করা যাবে না। যেমন হলো:- নকশি পিঠা, ভাঁপা পিঠা, ছাঁচ পিঠা, দোল পিঠা, রস পিঠা, পাকান পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চিতই পিঠা, পাতা পিঠা, মুঠি পিঠা, ছিট পিঠা, মালাই পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, ঝাল পিঠা, খেজুরের পিঠা, পুলি পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, ছিটকা পিঠা, চাঁদ পাকন পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা,পানতোয়া পিঠা, জামদানি পিঠা, মালপোয়া পিঠা, ভেজিটেবল সরভাজাপিঠা,তেজপাতা পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, কাটা পিঠা, লবঙ্গ লতিকা পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, হাঁড়িপিঠা, মুঠিপিঠা, চুটকিপিঠা, গোকুল পিঠা, রস ফুল পিঠা, নারকেল পিঠা, পুডিংপিঠা, আন্দশা পিঠা, সুন্দরী পাকন পিঠা, মেরা পিঠা, তেলেরপিঠা, চাপড়িপিঠা, দুধ- রাজ পিঠা, সেমাই পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুল পিঠা, গোকুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, ঝিনুকপিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, কলা পিঠা, ক্ষীরকুলি পিঠা, কুশলি পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, ঝাল মোয়া পিঠা,নারকেল জেলাফি পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি পিঠা, নারকেলের সেদ্ধ পুলি পিঠা, নারকেল- নাড়ু পিঠা, ফিরনি পিঠা, চিড়ার মোয়া পিঠা কিংবা কাউনের মোয়াপিঠা ইত্যাদি নাম অঞ্চলভেদে পিঠা হিসেবেই যেন বিবেচ্য। গ্রামে গ্রামে রং-বেরঙের পিঠা, ক্ষীর ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে শীতমৌসুমে। আর হতদরিদ্র মানুষের বাড়িতেও হরেক রকমের পিঠাপুলির আয়োজনের দৃশ্য সত্যিই যেন সর্বশ্রেণীর মানুষদেরকে আনন্দ দেয়। এমন শীতে দেশের নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে রকমারি পিঠা উৎসব হয়। তা ছাড়াও খেজুর রসের তৈরি পায়েস এবং বিভিন্ন রকম সু-স্বাদু পিঠা নিয়েই যেন পৌষ-সংক্রান্তির উৎসবও জমে ওঠে। আর নিজের বাড়ি ছাড়াও সন্ধ্যায় হাট-বাজারে যেন আতপ চালের গুঁড়া, নলেন গুড় এবং নারিকেল দিয়ে গণমানুষের জন্য তৈরি করা গরম ভাপা পিঠা বা পাটিসাপটা পিঠা খাওয়ার নান্দনিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করার মতো। অন্যকে খেতে দেখলে নিজেরও অজান্তে জিহ্বাতে পানি এসেই যায়। সকালে খেজুরের -“মিষ্টি রস আর মুড়ি” খাওয়া সবার মন কাড়ে। গাছিরা কলস ভরে ‘রস’ নিয়ে আসার নান্দনিক দৃশ্য চমৎকার। চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মে শীত ঋতুর খেজুর গাছ ও গাছিরা না থাকলে শীত ঋতুর তাৎপর্য ফুটে উঠে না। খেজুরের “কাঁচা রস” রোদে বসে খাওয়ার মধ্যেই একটা- আলাদা স্বাদ আছে। আর সুন্দর পরিবেশের মধ্যে খেজুর রসের পায়েস আর নলেন গুড়ের কথা ভাবলেই যেন মনে হয় এমন বাংলায় বারবারই ‘শীত’ ফিরে আসুক। ইতিবাচক আর নেতিবাচক যাই হোক শীতের সৌন্দর্য প্রকৃতি আর জনজীবন বিমোহিত হয়।
বাতাসে নতুন ধানের গন্ধে যেন ভেসে বেড়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশ। শীতে বেশির ভাগ জমিতেই ফসল থাকত না। আবার যে জমিতে ধান কিংবা ফসল হয় তার খড়কুটো জমিতেই বেশি থাকে। সেই রকম কোনো জমিতেই প্রায় প্রত্যেক শীতে ফুটবলের মাঠ এবং ক্রিকেট খেলার পিচ তৈরি করে দামাল ছেলেরা আনন্দ করে। হয়তো গ্রামের কোথাও খেলা ধুলার কোনো জায়গা বা জমি না থাকে, তখন তারা বাড়ির আসেপাসে খেলাধুলার জন্যে সীমিত ভাবে খেলতো, ক্রিকেট খেলায় ছক্কা মারা হতোনা। তাই শীতের খেলার জন্যেই উন্মুক্ত মাঠের পিচের গুরুত্ব ছিল বিশাল। গ্রামে শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। ব্যক্তিভেদে জীবনযাপনের ভেদাভেদ উহ্য থাকলেও এই শীতের সময়টা মনোমুগ্ধকর হয়েই উঠে। শীতের সকাল, বিকেলের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বৈচিত্র্য অন্য সময় তা দেখা মেলে না। ভোরের শিশির ও শিশির ভেজা গাছের সকল পাতা, ঘাস ও কুয়াশা সহ দিন রাতের শীতল আমেজের অনুভূতি উপভোগ করার মতোই। হাড় কাঁপানো কুয়াশা শীতেকালে গ্রামাঞ্চলের দামাল ছেলেরা খাওয়াদাওয়ার কিছুক্ষন পরেই যেন জড়ো হয় নিজ হাতে তৈরি খেলার মাঠে। শীতকালের এ খেলাধূলার আয়োজন অন্য ঋতুর চেয়ে ভালো পরিবেশ গড়ে উঠে। বাংলাদেশের গ্রামে বা গঞ্জে শীতে নানানধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়৷ কিন্তু সেই সংখ্যা কমে আসলেও কোন না কোনো অঞ্চলে তা এখনো অব্যাহত আছে৷ শীতে এখন ধর্মীয় উৎসবগুলো বেশি জাঁকজমক পূর্ণ ভাবেই হয়৷ আসলেই প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন থাকাতে মানুষ ঘরেই বিনোদন করে। বাইরে রাতে কম বাহির হয়। রক্ষণশীলতা বাড়লেও সাংস্কৃতিক চর্চা শীতেই ভালো হয়। শীতে রাতভর যাত্রাপালা দেখার উৎসাহ আজো গ্রামের মানুষেরা পায়। বাংলা ভাষাতেই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, শীতকাল নিয়ে রঙ্গরস ভরা কবিতা লিখেছে। আসলে ঠান্ডা পানি যে কত ভীতপ্রদ তা বর্ণনা করে ঈশ্বর গুপ্ত বলেন:- জলের উঠেছে দাঁত, কার সাধ্য দেয় হাত…/ আঁক করে কেটে লয় বাপ,/ কালের স্বভাব দোষ,… ডাক ছাড়ে ফোঁস ফোঁস…/ জল নয় এ যে কাল সাপ। নৈসর্গিক শীতের ছোয়ায় প্রকৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গে কিঞ্চিৎ হোক আর সর্ববৃহৎ হোক না কেন, তা যেন একেবারেই হত-দরিদ্র মানুষ কষ্ট দেয়। এক মহল শীতে আনন্দ উপভোগ করে অন্য মহল কষ্ট পায়। এটাই যেন শীতের বৈশিষ্ট্য। শীতের আমেজের সহিত এই হতদরিদ্র মানুষ সহ সকল শ্রেণী পেশার গণমানুষেরাই খুঁজে পায় ‘ধূসর প্রকৃতি’। আবহমান বাংলার মানুষ, হেমন্তের শেষ বিকেলে প্রকৃতির নান্দনিকতার মাঝে তাদের জীবনকে উপভোগ করার মজাটা যেন আলাদা ভাবে দেখে। শান্ত প্রকৃতিতে ষড়ঋতুতে শীতের আগমন বৈচিত্র্যময়। বাড়ে কুয়াশাময় শীতের দাপট তার সাথে বাড়ে বিভিন্ন পাখির সংখ্যা। দেশী-বিদেশী অসংখ্য পাখিরা সারাদিন মুখরিত রাখে কলতানে। এই সময় সূদূর সাইব্রেরিয়া সহ অন্যান্য দেশ থেকে পাখিরা বাংলাদেশে এসে মাঠে-ঘাটে ও গাছ থেকে গাছেই স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। শীতের অতিথী পাখিদের বদ করা হয় না। অন্য দেশে তীব্র শীত হওয়ার জন্যে এই দেশে অসংখ্য পাখিদের আনাগোনা হয়।
বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য পাঁচটি ঋতু হতে শীত কাল একটু বৈশিষ্ট্যর। আসলেই ভিন্নতার জন্যেই শুষ্ক চেহারা ও হিমশীতল অনুভব নিয়ে আলাদা হয়ে ধরা দেয় শীত। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। এ শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছ পালার পাতা গুলো ঝরে পড়তে থাকে।শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপরে যেন জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতিও হয় বিবর্ণ। সুতরাং কুয়াশাচ্ছন্ন সমগ্র প্রকৃতি, শিশির সিক্ত রাস্তা ঘাট কিংবা হিমেল বাতাস মিষ্টি মধুর আমেজ শীতকাল একটি ভিন্ন রূপ নিয়ে আসে। আবার কোনো কোনো গাছে থাকে না পাতা, ফুল বা কোনো মাঠেও থাকে না ফসল। আসলেই কর্ম মুখর প্রকৃতি যেন এখানেই এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। শীতকালে এদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যায়। সকাল বেলা নদীর পানি থেকে কুয়াশার ধোঁয়া সৃষ্টি হয়ে কুণ্ডলী আকারে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করে। নিঃস্তব্ধ গভীর রাতে গাছের পাতায় পাতায় শিশির বিন্দু জমতে থাকে। আবার ভোররাতে শিশিরকণা খুব বড় বড় ফোঁটায় এক ধরনের বৃষ্টির মতোই ঝরতে থাকে। টিনের চালে, ঘরের চালে, পাতার ওপর টুপটাপ বৃদ্ধির মতো পড়তে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করে।
পরিশেষে বলতে চাই, গ্রাম এবং শহরের সকল মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার জন্যেই শীতে কালের নিস্তব্ধ জনজীবন বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত হয়েছে। ঘরে বসে শীতবস্ত্র পরিধান করে টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং ফেসবুকের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সময় কাটায়। এ শীতকালে মানুষের জন্যে কিছু মানুষ খোঁজে পাওয়া যায়, তারাই হত-দরিদ্র মানুষকে, পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানুষকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারাই তো হলেন সরকার, দানশীল ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠন এর ব্যক্তি। দুস্থ-গরিবদের মধ্যেই শীত বস্ত্র বিতরণ করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। অপরদিকে এদেশের বিত্তবানদের গরম কাপড়ের প্রদর্শনী বাংলার প্রকৃতিতে মন ভোলানো রূপ বিরাজ করে। সকল শ্রেণির মানুষের মুখে হাসি এবং তারা শীতকালের বাহারিপোষাক পরেই ফুরফুরে মেজাজে থাকে। কবিরা কবিতায় বলেন- শীত, শীত, শীত উমের চাদরে মায়ের মমতা মাখা, আমার গাঁয়ের পথ চলে গেছে বহুদূর আঁকাবাঁকা। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়ে। একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু। বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথের এই কথা যুগে যুগে যাথার্থই। বাংলাদেশের গ্রামের শীতঋতু সত্যিই এর তুলনা হয় না। কোনো দেশেই নেই এই দেশের মতো এমন নয়নাভিরাম অলংকারে মুড়োনো প্রকৃতি ও মানুষ। কোথাও পাবে না খুঁজে এমন দেশটি- ‘বাংলাদেশ’।
লেখক: নজরুল ইসলাম তোফা: টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।