প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে থুসিডাইডিসের ফাঁদ ( থুসিডাইডিসের ট্র্যাপ)। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে এর উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস হতে। থুসিডাইডিসের ফাঁদ এই পরিভাষাটি গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের নামেই নামকরণ করা হয়েছে। এটি হচ্ছে সেই ফাঁদ যে ফাঁদে পড়েছিল এথেন্স ও স্পার্টা। উদীয়মান এথেন্স নিয়ে স্পার্টার ভীতি ও আধিপত্যের শংকা কিভাবে এই দুটি নগররাষ্ট্রকে এক অনিবার্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাই ইতিহাসে ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস ইতিহাসের পাতায় সুবিস্তরে তুলে ধরেছেন। মূলত সেখান থেকেই এই ধারণার উদ্ভব।
করোনা পরিস্থিতির পরেই পৃথিবীতে এক অনিশ্চয়তার খেলা শুরু হবে। পৃথিবীর বহুদেশ দেউলিয়া হতে পারে আবার কোনও কোনও দেশের এই ক্ষতি কাটাতে বহু বছর সময় লেগে যাবে।
করোনা পরবর্তী বিশ্বের ভূরাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে চীন – যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। বিশ্ব নতুন মাত্রার বি- বিশ্বায়ন বা ডিগ্লোবালাইজেশন হবে এবং অন্তত পক্ষে বৈশ্বিক অর্থনীতি দুটি ব্লকে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর এ ক্ষেত্রে সামনে পৃথিবীর অন্যদেশসমূহ একটি পক্ষকেই বেছে নিতে বাধ্য হবে যা শেষাংশে আলোচিত হবে।
বাণিজ্য যুদ্ধ রুপে উত্তেজনার যে শুরু সেটা করোনা পরবর্তী বিশ্বে সরাসরি স্থায়ী দ্বিপক্ষীয় শত্রুতায় রুপ নেবে। সে অনুসারে স্পর্শকাতর সেক্টর সমূহে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এর উপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বিধিনিষেধ এবং কৌশলগত শিল্পসমূহ যেমন – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ৫ জি ইত্যাদিতে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে আরও কঠোর হবে যুক্তরাষ্ট্র। আর বিশেষ করে ইউরেশিয়ান দেশসমূহে চীনের যে বিশাল কর্ম- পরিকল্পনা তাতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করবে কোনও মতেই যেন তারা এতে অংশগ্রহণ না করে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে একাধিক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা আছে গতমাসেও আরও দুটি যুদ্ধজাহাজের সংযুক্তি করোনার মাঝেও দুশ্চিন্তার ভাজ ফেলছে।
অপরপক্ষে চীন বিতর্কিত অঞ্চলসমূহে আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যার প্রমাণ মেলে মাত্র ৫ দিন আগে ভারতের প্রায় ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জোরপূর্বক দখল করে নেয়া। নেপালের মাধ্যমে চীনের যে কূটচাল তা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে রাখার চেষ্টা মাত্র, সংঘাতের চিন্তা এখনো কোনও পক্ষেরই নেই। আর নিজের শক্তিমত্তা ও নব বিশ্বের নতুন প্রভুর আগমনের ইংগিত শুধুমাত্র। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েতের সাথে চীনের তুলনা করা নিতান্তই বোকামি হবে। কারণ সোভিয়েত ছিল পতনশীল ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং ব্যর্থ অর্থনৈতিক মডেলের দেশ। কিন্তু চীন পুরোপুরিভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে জড়িত এবং বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
বি- বিশ্বায়ন বা ডিগ্লোবালাইজেশন এর ক্ষেত্রে যা বলার ছিল তা হচ্ছে ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ৫ জির মতন গুরুত্বপূর্ণ বহুবিধ প্রযুক্তিসমূহ নিয়ন্ত্রণ করবে ফলে সেখানে এক রকম মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা কোনও দেশের পক্ষেই সম্ভব হবে না। প্রতিটি দেশকেই বেছে নিতে হবে যে কোনও একটি পক্ষকে এবং এর মাধ্যমেই বি- বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার মাঝে ঢুকে পড়বে বিশ্ব। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। এই দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচতে চীন- যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই সুস্থ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য – সহযোগিতা করতে হবে। যদি এই সম্পর্ক ভুলভাবে পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থানকে ঠেকানোর অব্যাহত চেষ্টা রাখে এবং চীন এশিয়া বিশেষ করে ভারতসহ বিশ্বের অন্যত্র ( নেপাল কিংবা আফ্রিকার যে কোনও দেশসমূহে) তার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালায় তবে একটি পূর্ণমাত্রার গরম যুদ্ধ অথবা অসংখ্য প্রক্সি যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না হয়তো। বর্তমান সময়ে সরাসরি যুদ্ধ না হলেও অসংখ্য সিরিয়ার জন্ম হতে থাকবে। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে থুসিডাইডিসের ফাঁদ শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর চীনকে নয় বরং সারা পৃথিবীকেই গ্রাস করে ফেলবে।