মহাকাশ গবেষণা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা বিশ্বের বুকে বাতিঘর হিসেবে কাজ করে গেলেও এক সময় কিন্তু সভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ গবেষণা এবং ব্যয়বহুল অভিযানে ব্যাপক প্রযুক্তিগত সাফল্য লাভ করেছিল। তবে ইউরোপিয়ান এস্পেস এজেন্সি এবং জাপান এককভাবে মহাকাশ গবেষণা এবং আমাদের সৌর জগতে ছড়িয়ে থাকা গ্রহ বা উপগ্রহে উচ্চ প্রযুক্তির স্যাটালাইট প্রেরণ এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল মিশন নাসার পাশাপাশি নিজস্বভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে।
তবে প্রকাশ থাকে যে, মার্কিন, রাশিয়া, ইউরোপিয়ান এস্পেস এজেম্সি এবং জাপান ছাড়া বিশেষ করে ভারত এবং চীন প্রতি নিয়ত মহাকাশে নিজস্ব প্রযুক্তির স্যাটালাইট বা স্পেস পোর্ব বা ডিভাইস পৃথিবীর লো বা হাই অরবিটে প্রেরণ বা স্থাপন করে যাচ্ছে। তবে এক রকম নিয়মিতভাবে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে স্যাটালাইট উতক্ষেপণ বা প্রেরণের বিষয়টি আমার কাছে কেন জানি অতি মাত্রায় লোক দেখানো এবং বিশ্বের বুকে নিজেকে টপ ক্লাস প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ বা জাতি হিসেবে প্রকাশ করার কৌশল বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে চীন নির্বিচারে মহাকাশে শত শত টন স্পেস আবর্জনা সৃষ্টি করে বিশ্বকে নতুন এক বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আবার অন্যদিকে আর এভাবে প্রতি নিয়ত অসংখ্য স্যাটালাইট আকাশে প্রেরণ এবং তার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং শতভাগ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা বেশ প্রযুক্তিগতভাবেই বেশ জটিল এবং দীর্ঘ মেয়াদী একটি প্রক্রিয়া বটে। তাছড়া সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে চীনের তিন দশকে মহাকাশে প্রেরিত শতাধিক স্যাটালাইটের সাথে আদৌ কোন যোগাযোগ নেই কিম্বা এ স্যাটালাইটগুলো অকেজো হয়ে পৃথিবীর লো কিম্বা হাই অরবিটে বিচ্ছিন্নভাবে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে। যা কি না সে কোন মুহুর্তে পৃথিবীর যে কোন স্থানে আছড়ে পড়তে পারে এবং লোকালয়ে আছড়ে পরে বড় ধরণের ক্ষতি করে বসতে পারে।
অন্যদিকে নতুন করে মহাকাশে প্রেরিত স্যাটালাইটগুলোর সাথে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রকাশ থাকে যে, চীন বছর খানেক আগে নিজে একাই ঘটা করে মহাকাশে নিজস্ব স্থায়ী স্যাটালাইট স্টেশন তৈরি শুরু করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। অথচ বছর খানেক এর মধ্যেই দেখা গেল, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং চরম অদক্ষতা হেতু সেই স্পেস স্টেশন আর মহাকাশে থাকেনি। কিছু মাস পরেই তা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আছড়ে পরে। ভাগ্য ভালো যে, এই ম্যাসিভ জাঙ্কটি কোন মানব বসতির উপর আছড়ে পড়েনি।
তবে এটা ঠিক যে, চার দশক আগেই বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সভিয়েত ইউনিয়ন একাই তার স্থায়ী মীর মহাকাশ স্টেশন মহাশুন্যে স্থাপন করে বিশ্বের বুকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এক নজির স্থাপন করে গেছে। যে কাজ বা সাহস আজো কেউ এককভাবে করে দেখাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, সভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকলে আজ মানব জাতি হয়ত মঙ্গল গ্রহে নিজস্ব বসতি স্থাপন এবং সেখানে যাওয়া আসা এক রকম রুটিন মাফিক কাজে পরিনত হতো। যা হোক পূর্বের সভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমানে পুতিনের দেশ রাশিয়া কিন্তু বরাবরই হেভী রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড ডেভেলপমেন্ট এ বিশ্বের সেরা হিসেবে নিজের যোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে।
আমরা অনেকে হয়ত জানি না যে, মার্কিন স্যাটল পোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী এবং রসদ প্রেরণে এখনো পর্যন্ত রাশিয়ার সুয়ুজ হেভী রকেট এণ্ড স্পেস ডেলিভারী সিস্টেম একমাত্র মুল ভরসা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন স্যাট স্পেস ডেলিভারী সিস্টেমটি ধবংস হয়ে যাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট এখনো পর্যন্ত বিকল্প কোন হেভী রকেট এণ্ড স্পেস ডেলিভারী সিস্টেম লাউঞ্চ করতে পারেনি।
তাই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী এবং রসদ প্রেরণে এবং পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাশিয়ার সুয়ুজ হেভী রকেট সিস্টেম। আর এ মুহুর্তে বিশ্বে বুকে রাশিয়া ব্যাতিত অন্য কোন দেশের ব্যাপক মাত্রায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই এক সাথে দুই এর অধিক নভোচারীকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রেরণ এবং দক্ষতার সাথে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনার।
লেখকঃ সিরাজুর রহমান, শিক্ষক, কলামিস্ট।