একটা সময়ে গ্বয়াদর বন্দরের ছবি পাকিস্তানী ৫ রুপীর কাগজের মুদ্রায় শোভা পেতো, তা থেকেই বোঝা যায় এই নৌবন্দর, সন্নিহিত অর্থনৈতিক অঞ্চল আর সম্পর্কিত সড়ক, সেতু ও বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পাকিস্তানের জনমানসে কতোটা আশার উদ্রেক করেছিলো। ২০১৩তে শুরু হওয়া CPEC (চীন-পাকিস্থান অর্থনৈতিক সংযোগপথ) ২০২০ সাল আসতে না আসতেই অনেকটা থমকে পড়েছে। দুই তৃতীয়াংশ প্রকল্প আর কখনোই আলোর মুখ দ্যাখেনি, ব্যবসা বানিজ্যের যে জোয়ার আশা করা গিয়েছিলো তা আসেনি এখনো বরং ভাঁটা পড়ে গ্যাছে পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনীতিতে। গ্বয়াদরের ছবি সংবলিত ৫ রুপীর সেই কাগুজে মুদ্রাটি এখন লুপ্ত, বাতিল হয়ে গ্যাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহ থেকে।
সীপ্যাকের দরুন চীনের কাছে পাকিস্তানের ঋণ সুদে আসলে এবছরে ৬০ হাজার কোটি রুপীর কাছাকাছি পৌছে গ্যাছে যা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হিসাব অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে দেড়লাখ কোটি রুপীতে পরিণত হবে!
সাধারণত কোন দেশ যখন উন্নয়ন ঋণ ন্যায়, তার সুদের হার ২ শতাংশের উপর হয় না. উদাহরণ সরূপ বাঙলাদেশ জাপানের কাছথেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ যে ঋণ নিয়েছে তা ০.২ শতাংশ হারে প্রদেয়, তাও শোধ করতে হবে ৪০ বছর মেয়াদে।
পাকিস্তানী পত্রিকা দৈনিক ডনের এক প্রবন্ধ অনুযায়ী সীপ্যাকের আওতায় পাকিস্তান শুধুমাত্র বিদ্যুৎ খাতেই চীন থেকে $৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে তাও গড়ে ৪.৫ শতাংশ হারে এবং পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হবে ১০ বছরের ভিতরে!
এতো অস্বাভাবিক চাপ ও উচ্চহারের কারণ কি? মূলতঃ অন্ধভরসা! পাকিস্তান ভারতের বিপক্ষে চীনকে এক সহযোদ্ধা হিসেবে দ্যাখে, তাই ধরে নিয়েছিলো চীন হয়তো পাকিস্তানকে ভারত থেকেও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বানাতে চাইছে, তাই তারা যে দর চেয়েছে বিনা প্রতিবাদে, যাচাইবাছাই না করেই তাতে সাক্ষর করে বসে আছে পাকিস্তান। তাদের ভাবনা হয়তো ছিলো যে এসবই লোক দেখানো, আসলে অনুদানের পুরোটাই একটা দানবিশেষ, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা!
কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে সেই বিশ্বাসে চির ধরছে পাকিস্তানের। ৪৩ বছরের জন্য গ্বয়াদরের কর্তৃত্ব চীনের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক মুনাফা হয়নি কিছুই, গ্বয়াদর এখন পাকিস্তানের টাকায় তৈরী চীনা নৌবাহিনীর জন্য কৌশলগত দূরদেশীয় একটি পোতাশ্রয় ব্যতীত আর কিছুই নয়।
ধারণা করা হয়েছিলো শুধুমাত্র সড়ক ও সেতুর টোল বাবদই বার্ষিক ৬ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করবে পাকিস্তান, গ্বয়াদর একাই পাকিস্তানের একতৃতীয়াংশ অর্থনীতির উৎস হয়ে উঠবে। তাই হতো যদি গ্বয়াদরের সবগুলো ঘাটে ভরে থাকতো বিদেশী জাহাজ আর সন্নিহিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে আসতো অর্বুদ কোটি ডলারের ভিনদেশী বিনিয়োগ!
বাস্তবক্ষেত্রে বছরে বিশটির বেশী বানিজ্যিক জাহাজ ভেড়েনা গ্বয়াদরে, যদিও বন্দরটি একসাথে ১০০ জাহাজকে আশ্রয় দেবার ক্ষমতাসম্পন্ন। নিত্তনৈমিক বলতে শুধু করাচী থেকে অনিয়মিত ভাবে সাপ্তাহিক রসদ নিয়ে আসা একটি জাহাজ আর চীন থেকে কেনা দুটি যুদ্ধজাহাজ, যারা সারা বছর টহলরত থাকে গ্বয়াদরে।
বস্তুতঃ বালুচ স্বাধীনতা আন্দোলনের তোড়ে উড়ে গ্যাছে সব স্বপ্ন। চীনা প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের কার্যত বন্দী করে রাখা হয় প্রকল্প অঞ্চলে, বাইরে বের হলেও নিচ্ছিদ্র সেনা প্রহরার মধ্যে। তাস্বত্বেও ঘটে গ্যাছে বেশ কিছু দুঃখজ্নক ঘটনা, অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন গ্বয়াদরে আসা বেশ কিছু চীনা পর্যটক ও প্রকল্প কর্মীরা, সাথে সাথে ঘটেছে ব্যাপক গোলাবর্ষন এবং বিষ্ফোরক হামলার ঘটনাও, এননকি সুরক্ষিত ৫ তারকা পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে ঢুকে গোলাগুলি ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বালুচ জেহাদীরা। বিনিয়োগ দূরের কথা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার সুযোগ নেই গ্বয়াদরে।
পাক সেনাবাহিনী বসে নেই, অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরী করেছে তারা গ্বয়াদর অর্থনৈতিক অঞ্চলে। বন্দর হোক বা শহরের রাস্তাঘাট, প্রতিটি কোনায় কোনায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে সেনাদের সতর্ক প্রহরা। কিন্তু হিতে বিপরীত, অতিরিক্ত সেনা টহল ও খবর্দারী মানুষের মনে নিরাপত্তাভাব থেকে নিরাপত্তাহীনতার আতংক ছড়িয়েছে বেশী। ফলাফল যা হবার তাই, আশ্বাস স্বত্বেও সাউদী, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তূর্কীর কোন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসেনি গ্বয়াদরে।
২৪ বছরের করমুক্ত বানিজ্যের সুযোগ দিয়েও আজপর্যন্ত গ্বয়াদরে কোন উল্ল্যেখযোগ্য চীনা বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান, অথচ এই গ্বয়াদরকে কেন্দ্র করেই $৫০ বিলিয়ন ডলারের অধিক, উচ্চ সুদের ঋণ নিয়েছে তারা, তন্মদ্ধে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ঋণই $২০ বিলিয়ন ডলারের।
চীন স্বপ্ন দেখিয়েছিলো যে গ্বয়াদর পাকিস্তানের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেবে। রাজনৈতিক নেতারা মঞ্চে উঠে ভাষণ দিতেন যে সীপ্যাক হলে দুধ আর মধুর ফোয়ারা বয়ে যাবে পাকিস্তানের রাস্তা দিয়ে, পাকিস্তান দুবাই হয়ে যাবে! সেই দুধ আর মধু কোথায় হারিয়েছে কেউ বলতে পারেনা কিন্তু ঋণের ভারে হাবুডুবু খাচ্ছে পাকিস্তান। সুদ টানতে টানতে তাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বার জোগাড়, সীপ্যাকের বাইরে জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গ্যাছে, কোনমতে বড়জোর তিন মাস চলবার মতোন অর্থ জমা আছে কোষাগারে, তারউপর করোনা সংক্রমণে অর্থনীতি একদমই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
পাকিস্তানি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ২০২০ মার্চের ১৭ তারিখে পাক রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি চীন সফরকালে চীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাকিস্তানের এই অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার চিত্র তুলে ধরেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে এই অর্থনৈতিক চাপ থেকে নিব্রত্তির আবেদন জানান।
অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকার চীনের দারস্থ হয়েছে দুইটি দাবী নিয়ে, প্রথমত সুদের হার ৪.৫% থেকে কমিয়ে ২% করা হোক, দ্বিতীয়ত ঋণের মেয়াদ দশ বছর থেকে বাড়িয়ে ২০ বছর করা হোক। কারণ হিসেবে খান সরকার বলেছেন যে ইতিমধ্যেই ঋণের অংক পাকিস্তানী জনগণের সাধ্যের অতীত হয়ে গিয়েছে। দাবী দুটির কোনটাই অন্যায্য নয় কিন্তু আমেরিকার সাথে বানিজ্য যুদ্ধ ও করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে চীন এই আহবানে সাড়া দিতে কতোটুকু সক্ষম হয়, সেটাই এখন দেখবার বিষয়।
সূত্রঃ Daily Dawn, Daily Tribute, Columbia University: Center on Global Energy Policy ও অন্যান্য।
https://www.dawn.com/news/1549299
https://energypolicy.columbia.edu/research/report/china-pakistan-economic-corridor-power-projects-insights-environmental-and-debt-sustainability
https://www.scmp.com/news/asia/south-asia/article/3064849/chinas-us62-billion-belt-and-road-project-pakistan-risks
Will Balochistan Blow Up China’s Belt and Road?