বৈশ্বিক সামরিক গবেষণামুলক সংস্থা সুইডেনের ভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এসআইপিআরআই) চলতি ২০২০সালের ২৭শে এপ্রিল সারা বিশ্বের দেশগুলোর সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের একটি গবেষণামুলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যাতে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ১৯১৭.০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে। যা কিনা ২০১৮ সাল অপেক্ষা ৩.৬০% বেশি এবং ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাছাড়া ২০১৯ সালের মোট সামরিক ব্যয় বৈশ্বিক জিডিপির ২.২০% এবং বিশ্বের মাত্র পাঁচটি দেশ যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং সৌদি আরব বৈশ্বিক মোট সামরিক ব্যয়ের ৬২% ব্যয় করেছে।
সুইডেনের ভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এসআইপিআরআই) এর তথ্যমতে, একক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে সর্বোচ্চ সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা ব্যয় পূর্ববর্তী বছর অপেক্ষা ৫.৩০% বৃদ্ধি করে ৭৩২.০০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে। বিশেষ করে রাশিয়া এবং রেড জায়ান্ট চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকী মোকাবেলায় প্রতি বছরই সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে যাচ্ছে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন। তাছাড়া সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ এর কাছাকাছি সামরিক ঘাঁটি এবং ইরাক, সিরিয়া এবং বিশেষ করে আফগানিস্থানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ পরিচালনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
এই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়কারী দেশ হচ্ছে চীন। চীন সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রতি বছর প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে দেশটির অর্থ বিনিয়োগ এবং ব্যয় একেবারেই চমকে যাবার মতো। ২০১৯ সালে চীন সামগ্রিকভাবে ২৬১.০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে। যা কিনা ২০১৮ সাল অপেক্ষা ৫.১০% বেশি। তাছাড়া দেশটি সামরিক গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক ব্যয় করে। চীন তার মোট জিডিপির ১.৯% সরাসরি ব্যয় করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাত গবেষণা, উন্নয়ন ও পরিচালনায়।
এই তালিকায় প্রথমবারের মতো রাশিয়া এবং সৌদি আরবকে পিছনে ফেলে সর্বোচ্চ তৃতীয় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত। আর বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই আছে ভারতের অবস্থান। বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনের সাথে চলামান চীর বৈরিতা এবং দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক উত্তেজনা বজায় থাকায় ২০১৯ সালে ভারত সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে পূর্ববর্তী বছর অপেক্ষা ৬.৮% বৃদ্ধি করে ৭১.১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। যা কিনা তার মোট জিডিপির ২.৪%। তাছাড়া ২০১৮ সালে ভারতের সামরিক ব্যয় ছিল ৬৬.৫০ বিলিয়ন ডলার। ভারত ১৯৯০-২০১৯ এই ত্রিশ বছরের সময়কালে ২৫৯% সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে।
তবে ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তান সামরিক বাজেটে তালিকার শীর্ষ দশের মধ্যেও নেই। তবে বৈশ্বিক তালিকার হিসেবে ১৯তম স্থানে থেকে পাকিস্তান ২০১৯ সালে ১০.৩০ বিলিয়ন ডলার ডলার ব্যয় করেছিল প্রতিরক্ষা খাতে। যা কিনা ২০১৮ সাল অপেক্ষা ১.৮% বেশি এবং মোট জিডিপির ৪%। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সামরিক দিক দিয়ে শক্ত অবস্থানে তুলে নিয়ে যেতে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তিগত এবং সামরিক সহায়তা করে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চায়না।
বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাশিয়া ২০১৯ সালে তার সামরিক ব্যয় ৪.৫০% বৃদ্ধি করে ৬৫.১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। যা দেশটির মোট বার্ষিক জিডিপির ৩.৯%। তাছাড়া ২০১৮ সালে তৃতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরব এই প্রথম বার তার সামরিক ব্যয় ১৬% কমিয়ে পঞ্চম অবস্থানে চলে এসেছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরব ৬১.৯০ বিলিয়ন ডলার সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। যে দেশটির মোট জিডিপির ৮%। তবে ইয়েমেনে চলমান সামরিক অভিযান ও ইরানের সঙ্গে ব্যাপক সামরিক উত্তেজনার মধ্যেও সৌদি আরবের সামরিক ব্যয় হ্রাস করায় বিস্মিত হয়েছেন অন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকরা।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বৈশ্বিক সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের তালকায় ৫০.১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ফ্রান্স এবং ২০১৮ সালের তুলনায় সামরিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হার ১.৬%। ৪৯.৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৭ম অবস্থানে রয়েছে দেশ জার্মান এবং ২০১৮ সালের তুলনায় সামরিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হার ছিল ১০%। তাছাড়া ৪৮.৭০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৮ম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। যদিও এই সময়ে যুক্তরাজ্যের সামরিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হার ছিল ০%।
তবে উল্লেখ করার মতো বিষয়, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান ৪৭.৬০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৯ম অবস্থানে এবং এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৪৩.৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ১০ অবস্থানে চলে এসেছে। এই সময় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় জাপানের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ঋনাত্বক -০.১% এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৫%।
এই থিংক ট্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বিশ্বের উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক ১৬তম অবস্থানে থেকে সামরিক এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছিল ২০.৪০ বিলিয়ন ডলার এবং তা ২০১৮ সাল অপেক্ষা ৫.৮% বেশি। তাছাড়া ইরানের অবস্থান ছিল ১৮তম ও তারা সামরিক ব্যয় করেছিল ১২.৬ বিলিয়ন ডলার এবং তা ২০১৮ অপেক্ষা ১৫% কম। তুরস্ক তার জিডিপির ২.৩% এবং ইরান তার জিডিপির ২.৯% ব্যয় করেছে সামরিক খাতে। তাছাড়া ১১তম অবস্থানে থেকে ব্রাজিলের সামরিক ব্যয় ২৬.৯ বিলিয়ন ডলার, ইতালী ১২ তম স্থানে থেকে ২৬.৮ বিলিয়ন ডলার, ১৩তম অবস্থানে থেকে অস্ট্রেলিয়ার ২৫.৯০ বিলিয়ন ডলার, ১৪তম অবস্থানে কানাডার ২২.২০ বিলিয়ন ডলার এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ ইসরাইলের সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ছিল ২০.৫০ বিলিয়ন ডলার।
তবে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সামরিক ব্যয় এবং প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে (এসআইপিআরআই) এর প্রতিবেদনে কোন তথ্য সংযোজন করা না হলেও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশের সামরিক বাজেট ছিল ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার এবং তা পূর্ববর্তী ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ছিল ৩.৬৫ বিলিয়ন ডলার। আবার মোট জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয়ের হার ১.৫%। যদিও মিয়ানমারের প্রকৃত সামরিক ব্যয় নিয়ে সঠিক কোন হিসেব পাওয়া দুস্কর। তবে ২০১৯ মিয়ানমারের সামরিক বাজেট ছিল খুব সম্ভবত ২.৫১ বিলিয়ন ডলার এবং তা তার মোট জিডিপির ৪.৮%। যেখানে মায়ানমারের সামরিক ব্যয় ২০১৭ সালে ২.২২ বিলিয়ন ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৮ সালে ২.০৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাজেট কম মনে হলেও মিয়ানমার কিন্তু রাশিয়া, চীন এবং ভারতের কাছ থেকে একেবারে কম মূল্যে বা ছাড়কৃত মূল্যে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে বিনামূল্যে সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে।
সিরাজুর রহমান