বর্তমানে সারা বিশ্বে করোনা (কভিড-১৯) ভাইরাস এক ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও কিন্তু থেমে নেই বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলোর মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। বিশেষ করে চীন ৫ই মে, ২০২০ এ তাদের নতুন প্রজন্মের সুবিশাল লং মার্চ-৫বি হেভী রকেট এণ্ড ডেলিভারী সিস্টেম মহাকাশে পেরণ করে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। যদিও এই রকেটে করে একটি ডামি স্পেস ক্যাপসূল মহাকাশে স্থাপন করা হবে এবং ভবিষ্যতে নিরাপদে মহাকাশে নভোচারী কতটা দক্ষতার সাথে প্রেরণ করা সম্ভব হবে তা নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করাই ছিল এই নতুন মিশনের মূল উদ্দেশ্য। তবে রকেটটি ফিরে আসার পথে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ভেঙ্গে পড়ে এবং অল্পের জন্য রক্ষা পায় মার্কিন নিউয়র্ক শহর।
তাছাড়া মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পাশাপাশি রেড জায়ান্ট চীন ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষ করে বিগত চার দশকে গড়ে ওঠা চীনের সুবিশাল অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যে কারো কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে। এ মুহুর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের বার্ষিক জিডিপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ১৭.০০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছে গেছে। তাছাড়া বার্ষিক বৈদেশিক রপ্তানি ২.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বের প্রথম স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়নকারী দেশ হিসেবে ৩.২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এবং সোনার বিশাল মজুত গড়ে তুলেছে দেশটি। আর এই অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চীন মহাকাশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে কোন রকম ত্রুটি করছে বলে মনে হয় না।
১৯৬০ সালে রকেট প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাপক কাজ শুরু করলেও তা সার্ভিসে আনতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় রেড জায়ান্ট চীনকে। চীন কার্যত ১৯৭৫ সালে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির লিকুইড ফুয়েল চালিত ডিএফ-৫ লং রেঞ্জের হেভী রকেট (আইসিবিএম) সিস্টেম ব্যবহার করে আকাশে স্যাটালাইট প্রেরণ করে। তবে অবশ্য চীন তার অনেক আগেই ২৪শে এপ্রিল ১৯৭০ সালেই লং মার্চ-১ রকেটের সাহায্যে ১৭৩ কেজি ওজনের ডং ফেং হং-১ কমিউনিকেশন স্যাটালাইট প্রথম বার পৃথিবীর লো আর্থ অর্বিটে স্থাপন করে চীনা জাতির এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল।
এদিকে চীনের ইয়াং লিউই ছিলেন প্রথম মহাকাশ নভোচারী, যে কিনা ১৫ই অক্টোবর ২০০৩ সালে চীনের ইতিহাসে প্রথম মানব হিসেবে নিজস্ব প্রযুক্তির স্পেসক্রাফটে মহাকাশে গিয়েছিলেন। তারপর একে একে আরো ১০ জন নভোচারী মহাকাশে প্রেরণ করে চীন মহাকাশ প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পাশাপাশি নিজের শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, ২০১৭ সালে মহাকাশে থাকা স্যাটালাইট সরাসরি মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস করা এবং মাস খানেক আগে সমুদ্রে থাকা ভ্রাম্যমান কোন প্লটফর্ম থেকে হেভি রকেট মহাকাশের কক্ষপথে পেরণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পর হেভী রকেট ইঞ্জিয়ারিং এবং ডেভলপমেন্টে তৃতীয় কোন দেশ হিসেবে নিজের যোগ্য স্থান করে নিয়েছে। তাছাড়া চাঁদের বুকে এ নিয়ে ৭ বার স্যাটালাইট অভিযান প্রেরণ করলেও এ বছরের শুরুতে চাঁদের উলটো পার্শ্বে অন্ধকার অংশের চাঁদের মাটিতে সফলভাবে ল্যাণ্ডার নামিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে দেশটি।
যদিও কোল্ড ওয়ার চলাকালীন সময়ে বিশ্বের বুকে প্রথম একক কোন দেশ হিসেবে সভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে নিজস্ব মীর মহাকাশ স্পেস স্টেশন পৃথিবীর কক্ষ পথে প্ররণ করেছিল। তা দীর্ঘ দিন মহাকাশে অবস্থান করলেও সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লে তা আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। প্রকট আর্থিন সংকটের মুখে তৎকালীন রাশিয়ার বরিস ইলেতসিন সরকার মীর মহাকাশ স্টেশনকে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ধ্বংস করে ফেলে। তবে বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় কোন একক দেশ হিসেবে চীন ২৯ শে সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে নিজস্ব প্রযুক্তির তিয়ানগং-১ নামে প্রটোটাইপ আকারের স্পেস স্টেশন মহাকাশেই তৈরি করতে শুরু করে এবং তা কিন্তু ২ এপ্রিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬ বছর ১৮৫ দিন মহাকাশেই অবস্থান করেছিল। তবে প্রযুক্তিগত কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় এটিকে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তবে চীন এখন ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্বের তিয়ানগং-১ প্রটোটাইপ স্পেশ স্টেশন বিল্ডিং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবারো তাদের নতুন প্রজন্মের এবং নিজস্ব প্রযুক্তির তিয়ানগং-২ মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে বলেই প্রতিয়মান হয়।
চীন কিন্তু এরই মধ্যে ২০৩০ সালের আগেই চাঁদে বুকে নভোচারী প্রেরণের উপযুক্ত ৮.৬০ টন ওজনের স্পেসাল স্পেসক্রাফট তৈরি সম্পন্ন করে তার উপর এখনো পর্যন্ত ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মহাকাশে স্যাটালাইট প্রেরণে লং মার্চ-১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ সিরিজের হেভি রকেট ডেলিভারী সিস্টেম ব্যাপকভাবে কাজে লাগালেও বর্তমানে আরো আধুনিক এবং নতুন প্রজন্মের স্মার্ট ড্রাগন সিরিজের স্পেস্ক্রাফট ডিজাইন সম্পন্ন করেছে। চীন তাদের এই নতুন স্মার্ট ড্রাগন সিরিজের ২টি রকেটের টেস্ট ফ্লাইট সম্পন্ন করবে ২০২১ সালের দিকে৷ রকেটটি প্রায় ৩১০ মাইল উচ্চতায় ৫০০ কেজি পর্যন্ত পেলোড পৌছতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হয়৷ তাছাড়া ২০২১ সালে টেস্ট ফ্লাইট করা হবে স্মার্ট ড্রাগন-৩ রকেট সিস্টেমের৷ ১১৬ টন ওজন ও ৩১ মিটার লম্বা এই রকেট সিস্টেমটি অরবিটে ১.৫ টন পর্যন্ত পেলোড পৌছে দিতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছেন চীনের রকেট বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশেষজ্ঞ্ররা। অন্যদিকে, চলতি বছরের আগস্টে চীন তাদের নতুন প্রজন্মের স্মার্ট ড্রাগন-১ সিরিজের রকেটের সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করেছিল। এখন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে মহাকাশ বিজয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করার।
সিরাজুর রহমান