আমি জানি অনেকেরই চাওয়া ‘… আমি অন্ধকারের যাত্রী, আমায় আলোর পথ দেখাও…।’
কে দেখাবেন আলোর পথ? পথ অন্ধকারাচ্ছন্নই বা কেন? এই অন্ধকার, মনের। মানসিকতারও। চিন্তার। আবার চেতনারও। এই অন্ধকার কুসংস্কারের। আবার অশিক্ষারও। অথচ আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত এক একজন। সমাজে উচ্চ আসনে আসীন আমরা বিত্তে। চিত্তে কিন্তু ভয়শূন্য নই আমরা। তাই শির আমাদের উচ্চতায় খাটো। সুতরাং গৃহের প্রাচীরসম জ্ঞান আমাদের মুক্ত নয়। আসলে জড়ের শিক্ষা পেয়েছি আমরা। কিন্তু চেতনার শিক্ষা তো লাভ করতে পারলাম না আমরা।
এত গাঢ় অন্ধকার! পথ চলবো কী করে? এত হাজার বছরের জমাট অন্ধকার! কথায় বলে, হাজার বছরের জমাট অন্ধকার ঘরের অন্ধকার তৎক্ষণাৎ দূর করতে একটি দীপ শিখাই যথেষ্ট। তার জন্য আরও হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয় না। ‘গুরু’ হলেন এই দীপশিখা। বলার অপেক্ষা রাখে না হাজার বছরের জমাট অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি হলাম ‘আমরা’। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার দূরীভূতকারী-কে ‘রু’ বলা হয়েছে। যিনি দীক্ষাদানের মাধ্যমে বিমল জ্ঞান দিয়ে আমাদের সংশয়ের গ্রন্থিগুলোকে খুলে দেন। ফলত, আমার অ-জ্ঞান-এর পাপ রাশি বিলীন হয়ে যায়। তিনি অর্থাৎ গুরু হবেন শান্ত-দান্ত-কুলীন ইত্যাকার সৎ গুণসম্পন্ন এবং অবশ্যই তিনি হবেন পরোপকারী।
প্রসঙ্গত, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক হবে নিবিড়। এবং, তা নিত্যদিনের। এমটা নয় যে দীক্ষার পর গুরু-শিষ্যের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হবে না। গুরু এবং দীক্ষা যেন কোনওভাবেই ‘স্টেটাস সিম্বল’ হয়ে না দাঁড়ায়। এমন গুরুকে কিন্তু শাস্ত্র অনুমোদন করে না। তাছাড়া দীক্ষারও তো একটি রীতি-নীতি-পদ্ধতি রয়েছে শাস্ত্রে। শাস্ত্রের এহেন পন্থা বা পদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মন গড়া পদ্ধতিতে দীক্ষা কিন্তু প্রকৃত দীক্ষা নয়। অর্থাৎ দীক্ষার পবিত্র অর্থের পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি হল সেখানে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিন্তু একটি গৃহজীবন এবং একটি বিশ্বজীবন আছে। লক্ষ করতে হবে, কথাটি হল গৃহজীবন, গৃহীজীবন নয় এবং বিশ্বজীবন। গৃহস্থ ব্যক্তি মাত্রই সারাজীবন গৃহে অবস্থান করেন। গৃহ সংক্রান্ত কথা বলেন। সন্ন্যাস নিয়ে পাহাড়-পর্বতের গুহায় চলে যান না অথবা অরণ্যের গভীরে কুটির নির্মাণ করে জগৎবিচ্ছিন্ন, মানবিচ্ছিন্ন, সমাজবিচ্ছিন্ন সৃষ্টিকর্তার সাধনার আসন বিছিয়ে বসেন না। তাঁরা গৃহজীবনে থাকেন অথচ একটি বিশ্বজীবনও যাপন করেন। উভয় জীবনের তফাতটা কোথায়? আমাদের জীবনে গৃহজীবন শতকরা প্রায় একশো ভাগ। আমাদের ভেতরে বিশ্বজীবনটিকে খুঁজতে হয়। বিশ্বজীবন যে আমাদের জীবনে নেই, তা বলা যাবে না। পৃথিবীজুড়ে ‘করোনা’ আবহে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন। অথবা উম-পুন নামক সুপার সাইক্লোনে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন তাঁদের বেঁচে থাকার সম্বলটুকুও খুইয়ে বসেছেন এই পরিস্থিতিতে কিংবা যুদ্ধজনিত কারণে রক্তপাত ঘটে বেশকিছু সেনাবাহিনী প্রাণ হারান, তাহলে আমাদের মনে কষ্ট হয়। যাঁদের জন্য ব্যথা বা কষ্ট হয়, তাঁরা আমার বাড়ির কেউ নন, আমার পরিবারের কোনও সদস্যও নন। তা সত্ত্বেও আমরা যখন অপরের দুঃখে আমাদের হৃদয়ে যন্ত্রণা অনুভব করি, পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ উপলব্ধি করি, যতদূর সম্ভব আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। অথবা কোনও কারণে অপরের আনন্দে আনন্দ অনুভব করি। ওইটিই আমাদের হৃদয়ে বিশ্বজীবনের স্ফুলিঙ্গ।
তবে এটি আমাদের জীবনে খুব কম মাত্রা পায়। কারণ, আমাদের চিন্তা ও ভাবনার বেশিরভাগ অংশই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে আমাদের সংসার নিয়েই। আমাদের ক্ষুদ্র এবং সঙ্কীর্ণ গৃহজীবনটিকে নিয়েই। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণতারূপ মনের অন্ধকার গুরু দূর করেন তাঁর জ্ঞানকাজলের কাঠি দিয়ে। আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন তিনি। ফলত, আমরা ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণতা থেকে ক্রমশ বৃহৎ ও উদার মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার আলোকিত পথ খুঁজে পাই। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আমাদের মন এবং মুখ এক করার ওপর। যিনি তাঁর ব্যবহারিক জীবনে এটির বাস্তবায়ন ঘটাবেন শাস্ত্রের ভাষায় তিনিই হবেন মহাত্মা।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।