ঢালারচর এক্সপ্রেস, টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেসের ভীড়ে “রাজশাহী এক্সপ্রেস” এর নামটা শুনলে একটু মনটা আঁতকে ওঠে। আঁতকে ওঠা মনটা জানতে চায় ট্রেনটা কোথা থেকে রাজশাহী যায়? নাহ্, এবার তাহলে সত্যি সত্যিই আঁতকে ওঠা কথা বলি। ট্রেনটা মোটেও রাজশাহী যেতোনা। তবে যেতো রাজশাহীর উপর দিয়ে।চট্টগ্রাম থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ যেতো ফাইভ আপ রাজশাহী এক্সপ্রেস। আবার চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম ফেরৎ যেতো সিক্স ডাউন রাজশাহী এক্সপ্রেস।
সাধারণ একটি মেইল ট্রেন। কিন্তু দেশের এক বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে ছিল যোগাযোগের মেলবন্ধন। ট্রেন যাত্রীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেয় এক সময়। নেয় আমারও হৃদয়ে। কিন্তু কিভাবে?
আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে হাতে অখণ্ড অবসরে। বাবাও তখন অবসরে। এলপিআর শেষ হয়েছে, তাই পূর্ণ অবসরে। তিনি চট্টগ্রামে যাবেন তাঁর আনুতোষিকের কাগজপত্র ঠিক করার জন্য, সাথে আমিও। আর আমাদের বাহন অবধারিতভাবে সিক্স ডাউন বা রাজশাহী এক্সপ্রেস।
চট্টগ্রাম যাবো বলে মনে আমার দারুণ আনন্দ। নির্দিষ্ট দিনে পড়ন্ত দুপুরে বিকেলের আগে আগে ঈশ্বরদী স্টেশনে উপস্থিত হয়ে শুনি আমাদের প্রত্যাশিত ট্রেন চলছে অপ্রত্যাশিত বিলম্বে। আজ নাকি সন্ধ্যার পর যাবে। হয়ে গেল মেজাজটা খারাপ। রাগ করে ফিরে গেলাম বাড়ি। চট্টগ্রাম যেতে বাধা পেয়ে মনটা খারাপই হয়ে গেল।পরদিন আবার নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশন এবং মোটামোটি ঠিক সময়েই ট্রেনটা ধরে চট্টগ্রামের পথে রওনা। ট্রেনটা এক সময় এসে দাঁড়ালো চাটমোহর স্টেশনে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামনের দিকে মানে বেশ খানিক দূরে পূর্ব দিকে স্টেশনের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি ওটা একদিকে কাত হয়ে আছে। থাকবে নাই বা কেন? এই চাটমোহর হচ্ছে চলন বিল বিধৌত অঞ্চলে। এখানকার নরম মাটিতে কোন কিছুর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাই কষ্টের।
অবশেষে সূর্য্য নেমে গেছে পাটে। নিকষ কালো অন্ধকারের হাতছানি পথে-ঘাটে; ঠিক তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী রাজশাহী এক্সপ্রস নামক ট্রেনটা আমাদেরকে নিয়ে পৌঁছে গেল সিরাজগঞ্জ ঘাটে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে এবার উঠলাম ফেরীতে। কিন্তু ফেরীর আর ছাড়ার নাম নেই। অনেক সময় ধরে ফেরীতে মালামাল তোলা হলো। আমার যাওয়ার নেশা চট্টগ্রাম। কিন্তু ফেরী ছাড়তে দেরী হওয়ায় আমার খুব খারাপ লাগছিল যেতে দেরী হচ্ছে বলে। এক সময়ে পণ্য পরিবহন ছিল রেলের আয়ের অন্যতম মাধ্যম। প্রতিটা মেইল ও লোকাল ট্রেন এখনকার ১ আপ/২ ডাউনের মতো কয়েকটা লাগেজভ্যান থাকতো। যাত্রীদের ভ্রমণ আরামদায়ক করার জন্য রেল অনেক আগে থেকেই পণ্য পরিবহন প্রায় বাদই দিয়েছে।
অবশেষে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট। ফেরী থেকে নেমে আবার ট্রেন। আবারও কিছুটা সময় অতিরিক্ত অপেক্ষা। ফেরী থেকে পণ্যও উঠছে ট্রেনে। শুরু হলো ট্রেনের যাত্রা। জামালপুর পার হওয়ার পর পূর্ব গগন ফর্সা হলো। ধরিত্রী আলোকিত হলো উজ্জ্বল আলোকরেখায়। রেলপথের ধারের প্রকৃতি দর্শন আমার আজীবনের নেশা। পথের ধারে অনেক ঝোপ ঝাঁর দেখি, দেখি কাঁটা যুক্ত লতানো ঝোঁপ। কিন্তু আমি এর নাম জানিনা একজনকে জিজ্ঞেস করে আমি সেদিনই জানতে পারলাম এটাই সেই বেতঝোঁপ।এবার ট্রেন এসে দাঁড়ালো ময়মনসিংহে। কিন্তু ট্রেন আর ছাড়ছেনা। তত্ত্ব তালাশ করে জানা গেলো আন্তঃনগর এগারো সিন্ধুর ছেড়ে যাবার পরই আমাদের ট্রেন ছেড়ে যাবে। কারণ ভৈরব পর্যন্ত এই দুই ট্রেনের বিরতি একই আন্তঃনগরে পণ্য পরিবহন হয়না তাই ওটা আগে আগে চলে যাবে আর এটা পরে।এগারো সিন্ধুর ময়মনসিংহ ছাড়ার আগে আগেই দুইজন আমাদের কোচে উঠলেন। যাবেন গৌরীপুরে। তাঁদের বক্তব্য, যাবেন মাত্র একটা স্টপেজ! অতো টাকা দিয়ে টিকেট কাটার কোন দরকার আছে? তাই এই মেইল ট্রেনেই যাবেন। হ্যা, তখন এমনই ছিল। যাত্রীরা তাঁদের প্রয়োজন বা সামর্থ্যানুযায়ী আন্তঃনগর বা মেইল ট্রেনে চাপতো। ট্রেন মানেই এখনকার মতো কেবলই আন্তঃনগর নয়।
আগে ঢাকায় যাবার পথে ময়মনসিংহে এসে দেখেছি দোতালা রেললাইন। আজ সেই দোতালা দিয়ে আমার প্রথম যাত্রা হবে। কিভাবে কিভাবে কতোদূর দিয়ে ঘুরে লাইনটা উপরে উঠলো দেখার নেশায় জানালা দিয়ে মাথা বের করে থাকি। আব্বা বলেন বেশি দূর না, স্টেশন পার হয়েই দোতালা লাইন আর তার পাশেই শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ। আসলেই। আমার কিছুই দেখা হলোনা, মাথায় ঢুকলোনা কিছুই। কেমনে কেমনে জানি চলে আসলো দোতালা লাইনটা এবং প্রায় সাথেই শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ।
অতঃপর ট্রেন এসে দাড়ালো গৌরীপুরে। এখানে লোকোরিভার্স হবে। তাই আব্বার অনুমতি নিয়ে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। স্টেশনে বিরাট বড় সাইনবোর্ড। স্টেশনের নাম লিখা “গৌরীপুর ময়মনসিংহ জংশন”। আমি সামনের দিকে আগায়ে যাই; লোকো রিভার্স করার পর যেটা হয়ে যাবে ট্রেনে পেছন দিন। আমি অবাক হয়ে দেখি সবুজ গাছগাছালির ভেতর শ্যামগঞ্জের দিকে হারিয়ে যাওয়া রেল লাইনটা। আমিও হারিয়ে যাই ক’দিন আগেই পাঠ শেষ করা “পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকা”র মধ্যে। এই সবুজ বনানী নিরিবিলি পরিবেশে যে কেউ একটু নিরব হয়ে বসলে তো তাঁর মনে এমনিতে ভাবের উদয় হবে।
ট্রেন কিশোরগঞ্জের পরে যখন মানিকখালি পার হচ্ছে তখন আব্বা হাতের ইশারা দিয়ে বললেন “ঐ দিক দিয়ে মনোহরদী যায়”। মনোহরদী মানে আমাদের দাদাবাড়ী। আব্বা বললেন তাঁর মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার সময় মনোহরদী থেকে কয়েকজন একসাথে মানিকখালিতে হেঁটে এসে তারপর কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন। মোট রাস্তার দুইতৃতীয়াংশের বেশি হাঁটতে হতো। ট্রেন যখন সরারচর কুলিয়ারচর কালিকাপ্রসাদ পার হয় দেখলাম হাওড়ের হাতছানি। রেললাইনের ধার দিয়ে চলে যাওয়া রেলের নিজস্ব টেলিফোন লাইনের তারে বসে থাকা দেখলাম কিছু বিশাল বিশাল নাম না জানা পাখি। ভৈরবে পৌঁছানোর পর ট্রেনটার শুরু হলো উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলা।
চোখের পলকে মেঘনা নদীর উপরের শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম ব্রীজ পেরিয়ে আশুগঞ্জে একটু উঁকি দিয়ে ট্রেনটা দাঁড়ালো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। আখাউড়া পার হবার আব্বা বললেন ঐদিনে ইন্ডিয়া। হিলিতে যেমন রেললাইনের ধার দিয়ে ইন্ডিয়া এখানেও তাই। কসবা স্টেশনে একটা বড় প্রাচীর দেওয়া আছে দুই দেশের সীমানা হিসাবে। ট্রেনটা দূরন্ত গতিতে ছুটতে থাকায় সীমানার ওপারে শুধুমাত্র ভারত।
সমিত জামান
সম্পাদকীয় সহকারী, সাম্প্রতিক সংবাদ