পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠমিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবও যখন কাশ্মীর ইস্যুতে চুপ থাকা বা ভারতের পক্ষে থাকার পদক্ষেপ নেয় তখন ইসলামাবাদ সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। গেল বছরের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রিয়াদ এবং আবুধাবির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানান। ধারাণা করা হয়েছিল, এবার হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫’র এ ধারা বাতিলের পর থেকে পাকিস্তান অভিযোগ করে আসছে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বধির হয়ে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
কি হয়েছিল বৈঠকে?
বৈঠকে তেমন কিছু হয়নি। পাকিস্তান চেয়েছিল সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ওআইসি, সদস্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি বৈঠক আয়োজন করুক। যেখানে আরব বিশ্বের সামনে ইসলামাবাদ কাশ্মীর ইস্যুতে নিজের অবস্থান তুলে ধরবে। কিন্তু রিয়াদ এবং আবুধাবি কোনো বিবৃতি দেয়নি।
ইসলামাবাদ ছাড়া তেমন কেউ বিবৃতি আশাও করেনি। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতাদের নিয়ে পাকিস্তানের সেই বৈঠক শুধু ছবি তোলায় সীমাবদ্ধ থাকে। তারপর থেকে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি বৈঠক আয়োজনের জন্য সৌদি আরবের ওপর কঠোর চাপ তৈরি করে। কিন্তু সব সময় রিয়াদ ইসলামবাদের সে অনুরোধে নিশ্চুপ থেকেছে।
তবে কী সৌদি/আমিরাত ভারতের দিকে ঝুঁকছে?
আরও পড়ুন…
- পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী
- ২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক
- ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন
বিভিন্ন টিভি টকশো এবং সংবাদপত্রের কলামে উঠে এসেছে এখন কেউ কারো নৈতিক দায়িত্ব পালনে খুব একটা মনযোগী নয়। বড় গুরুত্বপূর্ণ বাজার আর বাণিজ্য। পাকিস্তানের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের কথায় কেউ কান দেয় না। বিষয়টি আংশিক সত্য হলেও পরিপূর্ণ নয়।
তাহলে পর্দার আড়ালের সত্যটা কী? যা রিয়াদ এবং আবুধাবিকে কাশ্মীর ইস্যু থেকে অব্যাহতভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে? উত্তর হতে পারে আর্থিক ঘনিষ্ঠতা এবং ভারতের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক।
১. ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব, দক্ষ জনবল, সৌদি-ভারত সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এবং সামরিক সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে এক দশকেরও বেশি সময় আগে থেকে পাকিস্তানকে রিয়াদের কাছে মূল্যহীন করে তুলেছে। ২০১৬ সালে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কিং আবদুল আজিজ পুরস্কারে ভূষিত করেন।
২. অতিসম্প্রতি কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫’এ ধারা বাতিল করে অঞ্চলটির উপর যখন অবরোধ আরোপ করা হয় তখন ভারতে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। পাকিস্তানে বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয় মাত্র ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণে পার্থক্যটা স্পষ্ট। ২০১৭ সালে সৌদি-পাকিস্তান বাণিজ্য হয়েছে সাড়ে ৭শ’ কোটি মার্কিন ডলার। ভারত-সৌদি বাণিজ্য হয় ২ হাজার সাড়ে ৭শ’ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৮ সালে সৌদি আরব থেকে ভারতীয় শ্রমিকরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১ হাজার ২০২ কোটি মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের শ্রমিকরা পাঠিয়েছে মাত্র ৪শ’ ৯০ কোটি মার্কিন ডলার।
৩. সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরবের চেয়ে কম উদ্বেগ জানিয়েছে। ভারতে আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আহমাদ আল বান্না কাশ্মীরে ভারতের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন, কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারপর ২৪ আগস্ট সৌদি আরবের মতো আমিরাতও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের নির্দেশে নরেন্দ্র মোদিকে দেশটির সর্বোচ্চ বেসমারিক পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রতিবাদে পাকিস্তান সিনেটের চেয়ারম্যান সাদিক সানজরানি পূর্বনির্ধারিত আমিরাত সফর বাতিল করেন।
গণতন্ত্র এবং নির্বাচন
১. এটি কেবল ভারত সম্পর্কে নয়, সৌদি এবং আমিরাত কখনই কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করবে না। মূল কারণ হলো সৌদি আরব সৌদ পরিবার দ্বারা পরিচালিত রাজতন্ত্র। সংযুক্ত আরব আমিরাত শেখদের দ্বারা পরিচালিত এক স্বৈরতন্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচিত হয় না। পারিবারিক সূত্রে নির্বাচিত হয়। সেখানে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নেই। বরং এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনো আন্দোলেন রাস্তায় নামার আগেই হাওয়া হয়ে যায়। চিন্তা করুণ সেই সৌদি-আমিরাত যদি কাশ্মীরীদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়াবে? সবচেয়ে বেশিবার যে প্রশ্নটি আমিরাত-সৌদির প্রতি বিশ্ববাসী ছুঁড়ে দেবে তাহল তাদের নিজেদের ঘরে কী গণতন্ত্র, মানবাধিকার আছে?
২. কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরব মনযোগী না বা কম মনযোগী এ সিদ্ধান্তে আমাদের মোটেও পৌঁছানো উচৎ নয়। বরং দেখার বিষয় কাশ্মীরে নতুন ছায়া যুদ্ধে নামতে পারে ইরান এবং সৌদি আরব। কাশ্মীরে নিজেদের ইসলামি চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে উভয়পক্ষ। মসজিদ, মাদরাসা এবং ধর্মপ্রচারকদের জন্য প্রচুর পরিমাণে তহবিল প্রবেশে করেছে উপত্যকায়।
কাশ্মীরে শিয়াদের সহায়তা করছে তেহরান
সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ভারতকে তীব্র তিরস্কার করেছেন। যা কাশ্মীরের শিয়াদের প্রতি তেহরানের জোর সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপে ভারতের নিরব সমর্থনও তিরস্কারের কারণ হতে পারে। খামেনির তিরস্কার কাশ্মীরীদের প্রতি ইরানের সমর্থনের পাশাপাশি সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরাতকে কাশ্মীর ইস্যু থেকে দূরে সরিয়ে দিতে কাজ করেছে বলেও ধারণা করা হয়।
কাশ্মীর ইস্যুতে পর্যাপ্ত সমর্থন না দেয়ায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি সরাসরি সৌদির বিরুদ্ধে বিষদাগার করেছেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরব যথার্থ ভূমিকা না নিলে, যেসব মুসলিম দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে তাদের নিয়ে আলাদাভাবে সমাবেশ করবে পাকিস্তান। তার এমন বক্তব্যের পর সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়।
আরও পড়ুন…
- পিটিয়ে হত্যা: ভিডিওতে শনাক্ত ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মী
- ২০২৩ এর সফল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড পেলেন সাইমন সাদিক
- ডিআর কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে সেনাবাহিনীর ‘আর্মড হেলিকপ্টার ইউনিট’ মোতায়েন
ইসলামাবাদের এমন বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি রিয়াদ। গভীর ফাটল ধরে দীর্ঘদিনের মিত্রতায়। তার এ বক্তব্যও কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি-আমিরাতকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। মুখ রক্ষার্থে শাহ মাহমুদ কুরেশি তার বক্তব্য খণ্ডন করেছেন। ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি-আমিরাত কখনো সমর্থন করবে কী না? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া এখন খুবই মুশকিল। যদি পাকিস্তান এমন আচরণ অব্যাহত রাখে তাহলে কোনো আরব দেশই কাশ্মীর ইস্যুতে ইসলামাবাদকে সমর্থন দেবে না বলেই ধরে নেয়া যায়।
লেখক: অনিরুদ্ধ ত্যাগী, ডিজিটাল কনটেন্ট প্রডিউসার, টাইমস অব ইন্ডিয়া। ভাষান্তর: ফাইয়াজ আহমেদ।