আন্তর্জাতিক অস্ত্র বানিজ্যে এবার বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে তুরস্ক। দেশটি এই প্রথম বারের মতো তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ২টি টি-১২৯ রিকর্নিসেন্স এণ্ড এ্যাটাক কমব্যাট হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে। চুক্তি মোতাবেক তুরস্কের তার্কীস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিআইএ) পর্যায়ক্রমে মোট ৬টি টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার চলতি ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই হস্তান্তর সম্পন্ন করবে।
আজ বুধবার ৯ই মার্চ তুর্কী বিমান বাহিনীর একটি এ-৪০০এম মিলিটারি কার্গো বিমানে করে এই দুটি হাইলি এডভান্স টি-১২৯ রিকর্নিসেন্স এণ্ড এ্যাটাক হেলিকপ্টার ফিলিপাইনে পৌঁছে দেয়। ফিলিপাইস সরকার এই ডেডিকেটেড ৬টি টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার ক্রয়ের জন্য সরকারি পর্যায়ে তুরস্কের সাথে ২৬৯ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পন্ন করে। সে হিসেবে প্রতিটি টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টারের ক্রয় মূল্য ৪৪.৮৩ মিলিয়ন ডলার হয়। তবে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী এর মূল্য অনেকটাই কম বা বেশি হতে পারে।
তুরস্কের টার্কিস এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিক (টিএআই) এর তৈরি টি-১২৯ ট্যাক্টিক্যাল রিকর্নিসেন্স এণ্ড এ্যাটাক হেলিকপ্টারটি আসলে ইতালিয়ান আগস্টা-১২৯ এট্যাক হেলিকপ্টার এর উপর ভিত্তি করে ডিজাইন ও তৈরি করা হয়েছে এবং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ইতালি থেকে নেয়া হয়েছে। তবে তার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিআইএ) তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির সমন্বয়ে ডেডিকেটেড টাইপের এই কমব্যাট হেলিকপ্টারে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও নতুন প্রজন্মের এভিয়নিক্স সিস্টেম দ্বারা সজ্জিত করেছে।
তুরস্কের তৈরি টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার সর্ব প্রথম আকাশে ওড়ে ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে এবং তার পাশাপাশি তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে প্রথম সার্ভিসে আসে ২০১৪ সালে। টার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই) ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭৬টি টি-১২৯ চপার তৈরি করেছে এবং তুরস্কের সামরিক বাহিনীর হাতে মোট ৬৫টি এই জাতীয় হাইলী এভভান্স এ্যাটাক চপার তুলে দিয়েছে।
দুইজন ক্রু দ্বারা চালিত এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারের দৈর্ঘ্য ১৪.৫৪ মিটার এবং উচ্চতা ৩.৪ মিটার। এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েট ৫,০৫৬ কেজি এবং ম্যাক্সিমাম স্পীড প্রতি ঘন্টায় ২৮১ কিলোমিটার। এর রেঞ্জ ৫৩৭ কিলোমিটার এবং ফেরিরেঞ্জ ১,০০০ কিলোমিটার। এটি যে কোন প্রতিকূল আবহাওয়ায় ও পরিবেশে আকাশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠতে পারে এবং এটি একটানা ৩ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে কমব্যাট মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম। তাছাড়া আকাশে সাবলীলভাবে উড্ডয়ন করার জন্য এই হেলিকপ্টারে ২টি অত্যন্ত শক্তিশালী আমেরিকার তৈরি হানিওয়েল টি-৮০০-৪এ টার্বোশেফট মাউন্টেন্ড ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।
এই চপারের প্রধান অস্ত্র হিসেবে একটি ২০ এমএম রোটারি ক্যানন ইনস্টলেশন করা হয়েছে। যা কিনা তিনটি ব্যারেলে মোট ৫০০ রাউন্ড গুলি ফায়ার করতে পারে। তাছাড়া এর ৪টি হার্ড পয়েন্টে সর্বোচ্চ ১,২০০ কেজি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের গাইডেড এন্ড আনগাইডেড রকেট ও মিসাইল বহণ করতে পারে। এটি ৪টি পডে মোট ৭৬টি আনগাইডেড রকেট বহণ করার পাশাপাশি ৮টি গাইডেড এন্টি ট্যাংক মিসাইল, ১৬টি রকেটসানের তৈরি সিরিট গাইডেড মিসাইল এবং ৮টি সর্ট রেঞ্জের এয়ার টু এয়ার স্টিংগার মিসাইল বহণ করতে পারে। তাছাড়া এটি প্রতি ২৯৪ কেজি ওজনের ২টি ড্রপ ট্যাংক বহণ করে।
এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারের এডভান্স এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে তার্কিস এ্যাসেলসান কোম্পানির তৈরি এএসইএলএফএলআইআর-৩০০টি ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল এফএলআইআর সিস্টেম ইন্সটল করা হয়েছে। তাছাড়া কাউন্টারমেজারস হিসেবে এটিতে কাউন্টারমেজার ডিসপেন্সিং সিস্টেম, একটি মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম, একটি লেজার ওয়ার্নিং সিস্টেম, একটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার, একটি রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার (আরডাব্লিউআর), ইনফ্রা-রেড কাউন্টারমেজারসবং একটি সুইট কন্ট্রোল প্রোসেসিং সিস্টেম (এসসিপিএস) ইনস্টল করা হয়েছে। তাছাড়া সর্বোশেষ সংযোজন হিসাবে এতে ১২ কিলোমিটার রেঞ্জের মিলডার মিলিমিটার ওয়েব রাডার ব্যবহার করা হচ্ছে।
এতদিন তুরস্ক টি-১২৯ ট্যাকটিক্যাল কমব্যাট চপারের একমাত্র ব্যবহারকারী দেশ হলেও বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপিন্স এর অন্যতম আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাছাড়া পাকিস্তান ২০১৮ সালে ১.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩০টি এই টাইপের চপার কেনার চুক্তি সম্পন্ন করলেও চপারে আমেরিকার ইঞ্জিন ব্যবহার জনিত জটিলতা এবং বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশের ইঞ্জিন সজ্জিত টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার পাকিস্তানের কাছে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে এই চুক্তিটি আপাতত বাতিল হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এখানে আমেরিকার আশাঙ্কা পাকিস্তানের কাছে হানিওয়েল ইঞ্জিন সজ্জিত টি-১২৯রিকর্নিসেন্স এণ্ড এ্যাটাক কমব্যাট হেলিকপ্টার দেয়া হলে এতে ব্যবহৃত আমেরিকার প্রযুক্তি খুব সহজেই চীন হাতিয়ে নিতে পারে। যদিও ফিলিপাইনের কাছে তাদের ইঞ্জিন সজ্জিত চপার রপ্তানি করার ক্ষেত্রে তুরস্ককে ২০২১ সালেই অনুমোদন বা লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।