পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির ২৩ বছেরে পা রাখলেও আবার অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য এলাকা। অশান্তির মূল কারণ হলো পার্বত্য শান্তিচুক্তির অবাস্তবায়ন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ সম্পাদিত হয়।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনের আজ ২ত বছর চলেছে, তথাপি পার্বত্য শান্তিচুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো আজ অবধি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। আমরা সবাই জানি যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ, জুম্ম জাতিগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা এবং তাদের নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সুরক্ষার ভিত্তিতে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের জন্য স্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথমে গণতান্ত্রিক ও পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে।
সশস্ত্র সংগ্রামরত অবস্থায় সাতবার বৈঠকের পর দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকার আঞ্চলিক পরিষদসংবলিত স্বশাসন প্রদানে সম্মত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়। আঞ্চলিক পরিষদসংবলিত স্বশাসনের মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণসহ ২২টি বিষয়ের ওপর ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপাহাড়ি বা অজুম্ম বসতি নিয়ন্ত্রণ, পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর ও সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটারতালিকা প্রণয়নপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ও অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ও অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার করা এবং পাহাড়িদের বেদখলকৃত ভূমি ফেরত প্রদান করা ছিল অন্যতম।
এসব বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিগুলোর অস্তিত্ব সুরক্ষা এবং তাদের উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। পার্বত্য শান্তিচুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুক্তি সম্পাদনকালে এই চুক্তিকে ‘শান্তিচুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তিনি এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেছিলেন, যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, সে কারণে এই চুক্তির নাম ‘শান্তিচুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো।
শান্তিচুক্তির ২ত বছরের মাথায় এসে প্রশ্ন থেকে যায় শান্তিচুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে কি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। গতকাল ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবারেও সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ দু’জনের মৃত্যু ও যুবলীগ নেতাসহ ৫জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় পর্বত্যবাসীসহ পুরো জাতিকে পুনরায় ভাবিয়ে তুলছে।
পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছিল। একইভাবে আমরা বাংলাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসেও তা লক্ষ করেছি। নিষ্পাপ সাধারণ জনগণের করুণ আর্তনাদ ও শ্বাস-প্রশ্বাসে,চলনে বলনে প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্নতা!
শাসকগোষ্ঠী, স্থানীয় পাহাড়ি -বাঙালি জনগণের সঙ্গে কি তাহলে জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ? কথিত রয়েছে তিনি আজ-অবদি জাতীয় পরিচয় পত্র গ্রহণ করেননি, ভোটার তালিকায় তার নাম নেই এমনকি জাতীয় দিবসগুলি পালনের অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতায় তার দেখা মেলে না। এ প্রসঙ্গে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১ ডিসেম্বর ২০১৯ এর এক প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “সবাইকেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে, তবে ভোটার হতেই হবে এমন কথা নেই। দেশী আইনে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বিষয়টি একান্তই ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।”
এবার আপনারই বলুন তার এমন্ত মন্তব্য কি “ডাল’মে ক্যুচ কালা হ্যায়” এর মতো নয়? সন্তু লারমাকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রায় এক বছর আগে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে তার ব্যক্তিগত ও ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভেতর আরেকটি দেশ প্রতিষ্ঠা করার পাঁয়তারা করছেন তিনি। বাংলাদেশের মত একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও সন্তু লারমা এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি। এটাই কি তার রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ? তিনি নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক দাবি করেন অথচ তিনি নিজ এলাকার ভোটার নন। তখন গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছিলো। প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউইয়র্ক মেইলকে জানান বলে একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চল ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পাহাড়কে করা হচ্ছে অস্থিতিশীল। একইসঙ্গে সেনাবাহিনীকে ঘিরে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এসবের পেছনে সন্তু লারমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে আমরা মনে করছি।
যেমন গতকালের ঘটেযাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরেন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমাকে দায়ী করে বান্দরবান শহরে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ সহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম চৌধুরী, পৌরশাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি অমল কান্তি দাস, সাধারণ সম্পাদক সামশুল ইসলাম, পৌর কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান খোকন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাওছার সোহাগ প্রমুখ।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনার জন্য সন্তু লারমাকে দায়ী করেছেন। দ্রুত হামলাকারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম চৌধুরী।
সুতরাং এখনই সময় এবিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা যেন অশু অনাকাঙ্ক্ষিত গণ-রাষ্ট্র বিধ্বংসী এড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।