যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫.৯০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমান অর্থ বিদেশে থাকা কোন গোপন কিংবা অবৈধ ব্যাংক একাউণ্টে পাচার হয়ে গেছে। যা কিনা টাকার অংকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমান। আর এই পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগই বৈদেশিক বানিজ্য জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে শিল্প উতপাদনের কাঁচামাল আমদানির নামে অভার ইনভয়েস, রপ্তানিকৃত পন্যের কম মূল্য দেখিয়ে (আণ্ডার ইনভয়েস) দেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে করা হাজার কোটি টাকা ঋনের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর বিদেশে যে চলে যাচ্ছে না তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
তাছাড়া বিদেশে অর্থ পাচারের শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। সে হিসেবে বিদেশে টাকা পাচারের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারতের পর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জিএফআই’র মতে, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বানিজ্যিক লেনদেনের প্রায় ১৯.০০% কোনো না কোনোভাবেই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং সেই অর্থ দেশে ফিরে আসার সম্ভবনা একেবারেই ক্ষীণ।
তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬.৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয় এবং সেই হিসেবে বিগত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। যা কিনা বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋন এবং অনুদানের কয়েকগুণ। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া রফতানি এলসি (ঋণপত্র) এবং ক্রয়চুক্তির ভূয়া কাগজ পত্র দাখিল করে বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি তদন্তে এ ধরনের এলসি জালিয়াতি ঘটনা সামনে আসলেও বাস্তবে এসব জঘন্য অর্থ জালিয়াতকারীদের সিন্ডিকেটের কবল থেকে দেশ কোন ভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না।
তাছাড়া মালয়েশিয়ার সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক তথ্যমতে, বিদেশীদের জন্য খোলা মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে অবস্থান করেছে বাংলাদেশের নাম। তার মানে মালয়েশিয়ায় বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈশ্বিক বিনিয়োগকা হচ্ছে বাংলাদেশের কিছু দূর্নীতিবাজ শিল্পপতি এবং অর্থ পাচারকারী ধনী ব্যাক্তিরা। তারা মুলত বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানী লণ্ডারীং আইনকে অমান্য করে এবং দেশের প্রচলিত আইনের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো দেশ থেকে নির্বিচারে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ থেকে অন্য কোন দেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। তবে প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু বিগত দশ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করার জন্য কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের হাজারো শাখা থেকে বড় আকারের গ্রুপ অব ইণ্ড্রাস্ট্রিজ থেকে শুরু করে একেবারে ছোট পরিসরে ব্যবসায়ী কিম্বা উদ্যোক্তাদের ব্যাংক থেকে নির্বিচারে ঋন গ্রহণের প্রবণতা এবং হার ভয়ঙ্কর আকারে পৌছে গেছে। শিল্প উন্নয়ন ঋন, রপ্তানি পন্যের কাঁচামাল আমাদানির ব্যাংক এলসি, ক্ষুদ্র এবং মাঝারী বানিজ্যিক ঋন ইত্যদি নামের আড়ালে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের শেষ হিসেব মতে, আমাদের দেশে সব ব্যাংকের সামগ্রিক মন্দ ঋনের স্থিতির পরিমাণ আনুমানিক ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা বা তার কাছাকাছি। যার ৬০% পর্যন্ত আদৌ ভবিষ্যতে কোন দিন পরিশোধ হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। আর এসব ঋনের একটি বড় অংশ বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে থাকা অবৈধ ব্যাংক হিসাবে পাচার হয়ে কিংবা সরাসরি কোন বৈদেশিক ব্যানিজ্যে বিনিয়োগ করে আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষরুপী শয়তানেরা বিদেশে অর্থ পাচারের মহা উৎসবে মেতে উঠেছে।
তবে প্রকাশ থাকে যে, এ সমস্ত ঋন খেলাপী এবং বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা রাজনৈতিক প্রভাবকে অবৈধভাবে কাজে লাগিয়ে এবং অসাধু কিছু ব্যাংক সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাথে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের মাধম্যে কিম্বা দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং আইনের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকে থাকা দেশ ও জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত লুটপাট করে সফল শিল্পপতি কিম্বা দক্ষ উদ্যোক্তার নাটক করা তো চরম অমানবিক এবং দেশদ্রোহীতার সামিল নয় কী? উদাহরণ হিসেবে এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, আমাদের দেশের এমন একটি গ্রুপ অব ইন্ড্রস্ট্রিজ রয়েছে, তারা বিগত চল্লিশ বছর ধরে দেশে ব্যবসা করে গেলেও কাগজে কলমে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৬,৮০০ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ এই সম্পদের বিপরিতে এদের ঋনের পরিমাণ ১৪,০০০ কোটি টাকার সীমাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। তার মানে বিভিন্ন অপকৌশলে এবং ব্যাংকিং আইনের দূর্বলতাকে অনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে ইতোমধ্যেই পাচার করে ফেলেছে এসব বহুরুপী ব্যবসায়ীরা। অর্থ্যাৎ এখন এই ঋনগ্রস্থ গ্রুপ অব ইণ্ড্রাস্ট্রিজ তার ব্যবসা যতই গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় করে দেখাক না কেন ব্যাংকের এই বিপুল পরিমাণ ঋন আর কোন দিন পরিশোধ করার মতো আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করবে কিনা সন্দেহ। আর আমাদের দেশে এ রকম বড় আকারের গ্রুপ অব ইণ্ড্রাস্ট্রিজ থেকে শুরু করে একেবারে ছোট আকারের ইচ্ছাধারী ঋনগ্রস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও ব্যাক্তি এখনো পর্যন্ত লাগামহীনভাবে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে হ্যাঁ শত নেতিবাচকতার মধ্যেও আমাদের দেশে এখনো কিন্তু শতাধিক গ্রুপ অব ইণ্ড্রাস্ট্রিজ এবং হাজারো দক্ষ ও সৎ উদ্যোক্তা কিম্বা ব্যাবসায়ী রয়েছেন, যারা অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সাথে নিজ ব্যাবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন এবং প্রয়োজনের তাগিদে ব্যাংক থেকে ঋন নিচ্ছেন এবং তা সময় মতো পরিশোধ করে দেশ জাতির কল্যানে কিম্বা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। আর তাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধার কল্যানে দেশ কিন্তু আজ বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রসরমান উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
সিরাজুর রহমান