সিরাজুর রহমানঃ গত ৬ই ডিসেম্বর ভেনিজুয়েলায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সমাজতন্ত্রী পার্টি বড় ধরনের বিজয় লাভ করেছে। ভেনিজুয়েলার জাতীয় নির্বাচন পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মাদুরো ও তার ক্ষমতাসীন সমাজতন্ত্রী দল এ পর্যন্ত গণনা করা শতকরা ৮০ ভাগ ভোটের মধ্যে ৬৭.৭% ভোট পেয়েছে। বয়কট ভেঙে মাদুরো-বিরোধী যে জোট নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারা পেয়েছে মাত্র ১৮% ভোট। যদিও মার্কিন সমর্থিত বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো তার জোটকে নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী ইউরোপীয় দেশগুলো যখন মাদুরো সরকারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানামুখী চাপ সৃষ্টি করেছে ঠিক তখন তার দল এই বড় ধরণের বিজয় পেল। এ বিজয়ের মধ্যদিয়ে মাদুরো দেশটিতে তার ক্ষমতা আরো সুসংহত করলে। তবে নির্বাচনে যাই হোক না কেন, দেশটির চলমান চরম অর্থনৈতিক সংকট ও দুরাবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়ার আপাতত কোন সুসংবাদ থাকছেনা ভেনিজুয়েলা বাসীর জন্য।
আসলে ল্যাতিন আমেরিকার হ্যুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনিজুয়েলা আজ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে এবং পাশাপাশি চরম মাত্রায় দূর্নীতি ও সরকারি আর্থিক অব্যবস্থাপনা কিংবা অদক্ষার কারণে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক অবস্থা আরো ভয়াবহ পর্যায়ে টেনে নিয়ে গেছে। বর্তমানে ভেনিজুয়েলার কাগুজে মুদ্রানোটের মান নজিরবিহীনভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ২০২০ সালের ৬ই ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে ১.০০ ডলারের বিপরীতে ১,০৮৬,১৪১ ভেনিজুয়েলীয়ান বলিভার মুদ্রামান ধার্য্য করা হয়েছে। তাছাড়া আইএমএফ এর হিসেব অনুযায়ী দেশটির মুদ্রাস্ফীতি হার আশাঙ্খাজনক হারে সামিহা ৬,৫০০% এ পৌছে গেছে।
ভেনিজুয়েলায় সরকারিভাবে ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০ এবং ৫০০ বলিভার মুদ্রানোট চালু থাকলেও সেগুলো আর ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। ভয়ঙ্কর আকারের মুদ্রাস্ফীতির কারণে অযোগ্য মাদুরো সরকার দেশটিতে ১০ হাজার, ২০ হাজার এবং ৫০ হাজার এবং ১ লক্ষ বলিভার মানের মুদ্রানোট চালু করেছে।
চলমান করোনা মহামারির বিরুপ প্রভাবে বর্তমানে ভেনিজুয়েলার বার্ষিক জিডিপি (নমিনাল) ৬৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার এবং জিডিপির হার (মাইনাস) -২৫% এ পৌছে গেছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ বেকারত্ব হারের দেশের তালিকায় ভেনিজুয়েলা বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশটির বেকারত্বের হার ৪৪.৩০%। আর ভেনিজুয়েলার দীর্ঘ সময়ের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও চরম অভাবের মুখে দেশটি থেকে বিপুল সংখ্যক লোক পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
বর্তমানে ভেনিজুয়েলার বাজারে এক লিটার দুধের দাম ৪,৩৭,৭৩২ বলিভার, এক হালি ডিমের দাম মাত্র ১,১০,০০০ বলিভারের সমপরিমাণ এবং এক কেজি মুরগির মাংসের দাম প্রায় ১২ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ ভেনিজুয়েলিয়ান বলিভারের সমপরিমাণ। ল্যাতিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলা খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ হলেও দূর্নীতির কবলে আবদ্ধ দেশটি আজ কিন্তু খনিজ তেল বা ক্রুড ওয়েলকে রিফাইনিং করে এক লিটার ডিজেল কিংবা পেট্রোলে পরিণত করার কোন ক্ষমতা রাখে না। সেই আবার ইরান থেকে লক্ষ লক্ষ ব্যারেল পরিশোধিত তেল (পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন) এনে কোন রকমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকার।
২০ শে জুন, ২০২০ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচআরসিআর) তাদের ‘গ্লোবাল ট্রেনড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট শরণার্থী (বাস্তুচ্যুত) মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৯৫ লক্ষ প্রায়। আর বিশ্বের প্রথম স্থানীয় বাস্তুচ্যুত দেশ হিসেবে যুদ্ধ কবলিত সিরিয়ায় মোট শরণার্থী (বাস্তুচ্যুত) মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৬ লক্ষ এবং ভেনিজুয়েলায় কোন গৃহযুদ্ধ না চলা সত্ত্বেও দেশটির প্রায় ৩৭ লক্ষ সাধারণ মানুষ খ্যাদাভাব এবং চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে তাদের পার্শ্ববর্তী অন্য কোন দেশে শরণার্থী হিসেবে চলে গেছে। এখন বর্তমানে বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় শরণার্থী (বাস্তুচ্যুত) দেশের তালিকায় নিজের নাম লিখেয়েছে মহান নেতার দেশ ভেনিজুয়েলা।