চীনের পর প্রথম যে কয়টা দেশের ওপর কোভিড-১৯ ব্যাপকভাবে হানা দিয়েছে, সেগুলোর একটা হলো দক্ষিণ কোরিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা অনেক ইউরোপীয় দেশ যে ভুল করেছে, দক্ষিণ কোরিয়া তা করেনি। দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম থেকেই কড়া নিয়ম মেনে এই মহামারি মোকাবিলা করেছে। তারা সারা দেশ লকডাউন না করেই ভাইরাসের সংক্রমণ দারুণভাবে কমিয়ে এনেছে। দেশটির এই পদক্ষেপগুলো অন্য দেশগুলো ও সুশীল সমাজের কাছে অনুসরণীয় হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া কেমন করে পারল? প্রথম যে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, সেটি মোটামুটি এখন সবাই জেনে ফেলেছে। সেটি হলো করোনা মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ব্যাপক মাত্রায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা (অ্যাগ্রেসিভ টেস্টিং) এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং বা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি তারা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
অবশ্য শুধু টেস্টিং এবং ট্রেসিং দিয়ে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়নি। দেশটির বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ট্রেড ইউনিয়নসহ নাগরিক সমাজ নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা সরকারের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির দিকে নজর রেখেছে। ফলে সরকারের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলার সুযোগ কম ছিল। অর্থাৎ, মহামারি মোকাবিলায় সরকারকে সক্রিয় করতে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকার দ্রুত সরকারি প্রযুক্তি ও বেসরকারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে গুণগতভাবে উচ্চ মানসম্পন্ন পরীক্ষা কিট উৎপাদন করেছে এবং সর্বোচ্চ দ্রুততার সঙ্গে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো।
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার সে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের একদম শুরুতেই এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে দেশটিতে এখন পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ৬ শর বেশি। এ ছাড়া ৮০টি ড্রাইভ-থ্রু সেন্টার আছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা যেখান থেকে গাড়ি নিয়ে দ্রুত সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে গিয়ে পরীক্ষা করে আসেন। এভাবে দক্ষিণ কোরিয়া এখন প্রতিদিন ২০ হাজার লোকের করোনা পরীক্ষা করতে সক্ষম। এ ছাড়া সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা খরচে করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কোনো ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে তাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে; তার পরিচয় এবং তার সাম্প্রতিক গমনস্থল ও চলাচলের ইতিহাস প্রকাশ করা হয়েছে। সে কোথায় কোথায় গিয়েছিল এবং কোন কোন যানবাহন ব্যবহার করেছিল, তার সম্পর্কে জেনে তার সংস্পর্শে আসা লোকেরা কোয়ারেন্টিনে যেতে পেরেছে। কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোনের জিপিএস ডেটা, ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের রেকর্ড এবং সিসিটিভির ফুটেজের ওপর নির্ভর করেছে। এসব ব্যক্তিগত উপাত্ত ব্যবহার দক্ষিণ কোরিয়ায় বৈধ এবং এটি ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য এতে প্রাইভেসি বা একান্ত ব্যক্তিগত নিভৃতি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। দেশটির মানবাধিকার কমিশন আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশ করার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
করোনাযুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন ও এনজিওগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি। যে শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছে, তাদের ঘরে অবস্থান করতে সহায়তা করার জন্য কোম্পানিকে মজুরি দিতে ট্রেড ইউনিয়ন ভূমিকা রেখেছে। মৌলিক মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে এনজিওগুলো সরকারকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অভিবাসীদের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে উদার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যদি কোনো অবৈধ অভিবাসী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে আসে, তাহলে তাকে আটক করা হবে না কিংবা পরবর্তী সময়ে তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়েছে। দুই পক্ষের সদিচ্ছাই কাজটিকে সহজ করে দিয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মায়োং-হি কিম দক্ষিণ কোরিয়ার পিপলস হেলথ ইনস্টিটিউটের সেন্টার অব হেলথ ইকুইটি রিসার্চের পরিচালক এবং মহামারি বিশেষজ্ঞ।