গত ২৮শে আগস্ট চীনের শি জিং পিং সরকার দেশটির এক নতুন ও বিতর্কিত মানচিত্র প্রকাশ করে। যেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে ভারতের সম্পূর্ণ অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের বলে দাবি করে এ অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাউথ তিব্বত’। যদিও চীনের এই বিতর্কিত দাবিকে খুবই জড়ালোভাবে প্রত্যাখান করেছে ভারতের সরকার। এদিকে চীন শুধু অরুণাচল প্রদেশকে নিজের বলেই ক্ষান্ত হয় নি। বরং নতুন ম্যাপে তার সাথে আকসাই চায়না, সমগ্র দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ানকে নিজের দেশের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর তার সাথে অত্যন্ত বিতর্কিত মানচিত্রটিকে কিনা আবার নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে লঞ্চও করে দিয়েছে তারা।
আসলে বর্তমানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার পাশাপাশি চীন তার সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বিশ্বের সামনে জাহির করতে প্রায়ই তাদের মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের এই প্রোপাগান্ডা মেশিনের উপর ভর করেই বর্তমান যুগের স্বপ্নে দেখা সুপার পাওয়ার চীনের সামরিক আগ্রাসন ও রণ হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে চীনের এহেন অপকর্মের বিরুদ্ধে কিন্তু সরাসরি প্রতিবাদ ও তীব্র সমালোচনা করেছে ভারত, তাইওয়ান, ফিলিপাইন্স ও মালয়েশিয়া।
তাছাড়া ব্রিকস জোট গঠনের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই জোটে প্রধান দুই অংশীদার বিতর্কিত ম্যাপ ইস্যুতে ভারত ও চীনের মধ্যে ব্যাপক উতেজনা ও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে চীনের শি জিং পিং সরকার ভারতের সরকারকে বিষয়টি নিয়ে অতি মূল্যায়ন না করে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে। তবে এ কাজ কেন বার বার করা হচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা দেয়নি চীনের প্রশাসন। আসলে কৃত্রিমভাবে হলেও নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শক্ত অবস্থান জানান দিতেই হয়ত চীনের সরকার এ ধরণের বিতর্কিত ইস্যু বার বার প্রকাশ্যে আনছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
বর্তমানে চীন বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে দেশটি এখন তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা জাহিরের পাশাপাশি তার সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্ব সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন ধরণের বিতর্কিত ইস্যুকে সামনে আনছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। আপাতত সামরিক দিক দিয়ে চীন ভারত অপেক্ষা প্রায় তিনগুণ অধিক সক্ষমতা সম্পন্ন বলে মনে হলেও বাস্তবে চীনের এখন আর মূল প্রতিদ্বন্দী কিন্তু ভারত নয়।
এক কথায় বলা যেতে পারে চীনকে এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের এক নম্বর সামরিক সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যা চীনের জন্য একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। সামরিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিতে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেলেও বাস্তবে আমেরিকা বা রাশিয়ার সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা এখনো পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালানো, দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় দেশটি রাশিয়া বা আমেরিকার মতো কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা এক রকম নেই বললেই চলে।
বিশেষ করে গত বছর আমেরিকার পার্লামেন্টের স্পিকার ন্যান্সি পোলেসি চীনের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই যুদ্ধবিমানসহ তাইওয়ানে প্রবেশ করে। মুখে প্রতিবাদের পাশাপাশি পাল্টা শক্ত ব্যবস্থা নিতে না পেরে কয়েশো মাইল দূর থেকে বড় ধরণের সামরিক মহড়া চালিয়ে সারা বিশ্বে হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। চীনের এহেন তীব্র প্রতিবাদের কোন পাত্তা দেয়নি মার্কিন বাইডেন প্রশাসন। তাছাড়া বিগত ৪ দশকে চীন তাদের মিডিয়ায় আমেরিকাকে প্রায় কয়েকশো বারের অধিক চূড়ান্ত সর্তক বার্তা দিয়ে রেখেছে। আসলে যে যাই বলুক চীন এ মুহুর্তে বিভিন্ন দেশকে ভীতি প্রদর্শন ও উস্কানী দেয়া দেয়া ব্যাতিত আর কিছু করবে বলে মনে হয় না। মূলত চীন তার অর্থনৈতিক ক্ষতি করে ভারত তো দূরের কথা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে কোন দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে জড়াবে না।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বের সকল দেশ এখন চীনকে যথেষ্ঠ সমীহ করলেও বাস্তবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে একমাত্র উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমার ব্যাতিত আর কোন দেশের সাথেই অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন কিংবা কৌশলগত সম্পর্ক বিদ্যামান নেই। অধিকাংশ দেশই আজ কিন্তু চীনের বৈশ্বিক সম্পর্ক ও সীমান্ত নীতিতে খুবই বিরক্ত ভাব প্রকাশ করে থাকে। যা চীনের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ বৈশ্বিক নীতি বলে আমি মনে করি।
দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান অন্যান্য বেশকিছু বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে ব্যাপক সামরিক উত্তেজনা ও মতোভেদ বিরাজ করলেও চীন কিন্তু আমেরিকার ভয়ে কখনোই এসব বিতর্কিত এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সাহস করে দেখাতে পারেনি। যা করছে তা মুখে মুখে ও মিডিয়ায়। আর চীন ও উত্তর কোরিয়ার এহেন রণ হুংকারকে কাজে লাগিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ঠিকই একচেটিয়া অস্ত্র ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বলা যেতে পারে যে গত ২০২২ সালের শুরু থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত আমেরিকার বড় বড় অস্ত্র ম্যানুফ্যাকারিং কোম্পানিগুলো প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অস্ত্র রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে। যা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র চীন ও উত্তর কোরিয়ার ফাঁকা সামরিক আগ্রাসন ও হুংকারের জন্য। আর আমেরিকা যতদিন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে থাকবে ততদিন কোন যুদ্ধও হবে না, অস্ত্র বানিজ্যও বন্ধ হবে না।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com