অভিন্ন নদীগুলোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের কাজে জলের ব্যবহার নিয়ে এবার আরও দুই প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ল ভারত।
নেপাল-ভারত সীমান্তে গন্ডক নদীর ওপর যে ব্যারাজ আছে, তার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নেপাল বারবার বাধা দেওয়ার পর বিহার সরকার এ ব্যাপারে দিল্লির জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার
পাশাপাশি, আসামের বাকসা জেলার হাজার হাজার চাষী অভিযোগ করছেন, মিত্র দেশ ভুটান তাদের সেচের জল আটকে দিয়েছে।
বাকসার জেলা প্রশাসনও বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন যে তারা বিষয়টি নিয়ে ভুটানের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন।
কিন্তু ভারতের উত্তর সীমান্তে চীনের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই এবারে বিভিন্ন নদী নিয়ে কেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের বিরোধ?
বস্তুত লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পুয়াধারার মতো সীমান্তের বিতর্কিত এলাকাগুলোকে নেপাল নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার জেরে দিল্লি ও কাঠমান্ডুর মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই – এখন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে গন্ডক ব্যারাজ নিয়ে দুদেশের বিরোধ।
বহু বছরের সমঝোতা অনুসারে সীমান্তবর্তী এই ব্যারাজটি ভারতই বরাবর রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছে – কিন্তু এই মরশুমে টানা দশদিন চেষ্টা চালানোর পরও ভারতীয় প্রকৌশলীরা সে কাজে সফল হননি, বুধবারও তাদের ব্যারাজ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে।
বিহারের জলসম্পদ মন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা বলছেন, বাল্মীকিনগর জেলায় গন্ডকের ওপর যে ব্যারাজ আছে তাতে মোট ছত্রিশটা গেট আছে – আঠারোটা ভারতের দিকে, আঠারোটা নেপালের দিকে।
এখন নেপালের দিকে যে আঠারো নম্বর বা শেষ গেট, সেখানে তারা হঠাৎ প্রাচীর তুলে দিয়েছে।
ফলে বন্যা মোকাবিলার সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা ওদিকে যেতেই পারছেন না, বাঁধের ডানদিকের অংশ বা অ্যাফ্লাক্সটা বিরাট ঝুঁকিতে পড়েছে।
গন্ডক দিয়ে রোজ রাতে এখন দেড় লাখ কিউসেক জল প্রবাহিত হচ্ছে – কিন্তু আমরা যদি মেরামত আর মনিটরিংয়ের কাজই না-করতে পারি তাহলে পুরো উত্তর বিহারই ভীষণ বন্যার বিপদে পড়বে।
উদ্বিগ্ন বিহার সরকার এরপরই এই সঙ্কটে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়ে বুধবার দিল্লিতে জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে।
আসামে চাষীদের বিক্ষোভ
ওদিকে ভুটান সীমান্তবর্তী আসামের বাকসা জেলাতেও পঁচিশটি গ্রামের বেশ কয়েক হাজার চাষী বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন।
তাদের অভিযোগ, ভুটান সরকার তাদের অভিন্ন নদীগুলোর সেচের জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে, যে ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।
সমস্যা যে একটা তৈরি হয়েছে, বিবিসি বাংলার কাছে তা স্বীকার করেছেন বাকসার ডেপুটি কমিশনার রঞ্জন শর্মাও।
তিনি বলেন, এটা আসলে লকডাউনে ভুটান সীমান্ত সিল করে দেওয়ার কারণেই হয়েছে।
আমাদের চাষীরা এতদিন অবাধেই সীমান্ত পেরিয়ে ভুটানের দিকে চলে যেতেন, তারপর ছোট ছোট নদীর ধারাগুলো সুবিধেমতো চ্যানেল কেটে নিজেদের চাষের ক্ষেতে সেচের জন্য নিয়ে আসতেন।
সীমান্ত এখানে শিথিল, দুদিকের স্থানীয় লোকজন বিনা বাধাতেই এপার-ওপার যাতায়াত করেন, কাজেই কোনও অসুবিধা হত না।
কিন্তু এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে, এই বিষয়টা আমি আমাদের লাগোয়া ভুটানের সামড্রুপ জোঙ্কার জেলার ডেপুটি কমিশনারের কাছে জানিয়েছি, তিনি বিষয়টা দেখারও আশ্বাস দিয়েছেন।
ভুটান থেকে বেকি, পাগলাদিয়া, পুথিমারির মতো যে সব নদী ভারতে নেমে এসেছে, বাকসা জেলার কৃষকরা সেচের জন্য সেগুলোর অসংখ্য ছোট ছোট শাখানদী বা পাহাড়ি ঝোরার ওপরেই নির্ভরশীল।
এবারের চাষের মৌশুমে সেই সেচের জল না-পেয়ে তারা গভীর সঙ্কটে পড়েছেন।
ভারতের সুপরিচিত পরিবেশকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকর মনে করেন, নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে ভারতের এই ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে আসলে দুপক্ষেরই দায় আছে।
মেধা পাটকর বলেন, বিহার সরকারই বা বাঁধ মেরামতের কাজ এই জুন মাসে, এত দেরিতে শুরু করল কেন? এটা তো অনেক আগে, সেই শীতেই করা দরকার ছিল।
ফলে তারা যেমন শুধু নেপালকে দোষ দিতে পারে না, তেমনি নেপাল ও ভুটানেরও আরেকটু পরিণতিবোধ দেখানো উচিত ছিল।
আসলে এই নদী, জলধারা বা হিমবাহ তো কখনও একটা নেশন স্টেটের সম্পত্তি হতে পারে না, সেখানে সবার আগে দাবি মানুষের। সেইটা ভুলে গিয়ে যদি আমরা সেই মানুষগুলোকেই কোণঠাসা করি, সেটা খুবই অন্যায়।
লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘাত ও মানচিত্র নিয়ে নেপালের সঙ্গে বিরোধ আগে থেকেই দিল্লিকে অস্বস্তিতে রেখেছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, উত্তর সীমান্তের কোনও কোনও অভিন্ন নদীও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এনে হাজির করছে।