চুক্তি ভেঙে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়েছে বরিস জনসনের সরকার। ইইউ-র তীব্র প্রতিক্রিয়ার মাঝে ব্রিটেনের সংসদে বিষয়টিকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হচ্ছে।
ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও বিষয়টিকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে। এমনকি বরিস জনসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সাবেক পাঁচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী!
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার উদ্যোগ নিয়েই থামছেন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
ইইউ ব্রিটেনের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে।
মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে ব্রিটেনের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ বানচাল করে ইইউ এমনটা করতে চাইছে বলে জনসন দাবি করেছেন।
চলতি মাসে ব্রিটেনের সরকার সত্যি ব্রেক্সিট চুক্তি ভেঙে আইন প্রণয়ন করলে ইইউ সে দেশের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবার উদ্যোগ নিচ্ছে।
সেইসঙ্গে কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কেও ভাবনা চিন্তা চলছে।
দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া সম্ভব হলে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। তবে একবার আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার উদ্যোগ নিয়ে ব্রিটেনের বিশ্বাসযোগ্যতা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন এড়াতে ইইউ ব্রিটেনের কাছে কয়েকটি বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান দাবি করছে। চলতি সপ্তাহে ব্রাসেলসে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি আবার উঠে আসার কথা।
বলা বাহুল্য, ইইউ এমন দাবিকে ভুল ও প্ররোচনা হিসেবে গণ্য করছে। একাধিক ইইউ নেতা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন কোভেনি এমন দাবিকে ‘সত্য নয়’ বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে, এমন কোনো প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে না। ডাউনিং স্ট্রিট থেকে এমন প্ররোচনামূলক মন্তব্যের নিন্দা করেন তিনি।
অস্ট্রিয়ার অর্থমন্ত্রী গ্যারনট ব্ল্যুমেল বলেন, যখনই কোনো অগ্রগতি সম্ভব হয়, কোনো না কোনো সময় ব্রিটেন তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে চায় না। সোমবার ব্রিটিশ সংসদের নিম্ন কক্ষে নতুন আইনের খসড়া নিয়ে বিতর্কের আগেই একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্রিটেনের ভাবমূর্তি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দুই প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ‘সানডে টাইমস’ সংবাদপত্রে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করে লিখেছেন, এমন উদ্যোগ সরকার ও দেশের জন্য লজ্জাজনক। জন মেজর ও টোনি ব্লেয়ার এমন খোলাখুলি বরিস জনসনের সমালোচনা করায় রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠছে।
সংসদের উভয় কক্ষে সরকারি দলের অনেক ব্রেক্সিটপন্থি নেতাও চুক্তি ভাঙার বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না। তবে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তাঁরা খোলাখুলি বিদ্রোহের পথে যাবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। জনসনের সরকার যত দ্রুত সম্ভব আইন প্রণয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, শুক্রবার রাতে জনসন নিজে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রায় ২৫০ এমপি-র সঙ্গে কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি গত বছর সংসদের অচলাবস্থার কথা মনে করিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীর চাপের মুখে কিছু সংসদ সদস্য ব্রেক্সিট চুক্তিতে যে কোনো রদবদলের ক্ষমতা সরকারের বদলে সংসদের হাতে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
ব্রেক্সিট প্রত্যাহার চুক্তি সংশোধনের লক্ষ্যে বরিস জনসনের প্রস্তাবিত বিল প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছেন আরও তিন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
টনি ব্লেয়ার ও স্যার জন মেজরের পর এই আহ্বান জানিয়েছেন, ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে ও গর্ডন ব্রাউন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি ভঙ্গ করা সর্বশেষ উপায় হওয়া উচিত।
থেরেসা মে ও গর্ডন ব্রাউনও জনসনের এই প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়েছেন। এর আগে সাবেক কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী স্যার জন মেজর ও লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার লিখেছেন, সরকারের এই উদ্যোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন, নীতিগতভাবে ভুল এবং বাস্তবায়নে বিপজ্জনক।
এদিকে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইরিশ সাগরে একটি কাস্টম সীমান্ত আরোপ করতে চাইছে। এতে করে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
সোমবার হাউস অব কমন্সে ইন্টারনাল মার্কেট বিল নামের এই বিলটি বিতর্কের জন্য উত্থাপন করার কথা। এই বিলটি ২০২০ সালের শুরুতে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার প্রত্যাহার চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিলটি আইনে পরিণত হলে ব্রিটিশ মন্ত্রীদের ক্ষমতা থাকবে ব্রিটেন ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে পণ্য পরিবহণ বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের। ইইউ ও যুক্তরাজ্য যদি বাণিজ্যিক চুক্তিতে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে তাহলে ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হবে।
এদিকে ইইউ’র অভিযোগ, গত জানুয়ারি মাসে স্বাক্ষরিত ব্রেক্সিট চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে চাইছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
ইইউ কর্মকর্তা মারোস সেফচোভিচ বলেছেন, যুক্তরাজ্যের পরিকল্পিত বিলটি বিশ্বাসের গুরুতর ক্ষতি করেছে এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে লজ্জা পাবে ইইউ। যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভামন্ত্রী মাইকেল গোবের সঙ্গে জরুরি বৈঠকের পর এই হুমকির কথা জানান মারোস।
এই জটিলতার মধ্যেও লন্ডনে ফের ইইউ’র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন ব্রিটিশ প্রতিনিধি ডেভিড ফ্রস্ট ও মিশেল বার্নিয়ার।
অষ্টম দফার এই আলোচনার মূল বিষয় হলো, ব্রিটেনে রজলসীমায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকার ও শিল্পে সরকারি ভর্তুকি।
বিশ্লেষকদের মতে, রফতানি বাড়াতে দেশীয় শিল্পে ব্রিটিশ সরকার যাতে ভর্তুকি না দেয় তা নিশ্চিত করতে চাইছে ইইউ। কারণ, সরকারি ভর্তুকি প্রাপ্ত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির পক্ষে কম দামে পণ্য জোগান দেওয়া সম্ভব। এমনটা হলে মার খাবে ইইউ’র ২৭টি সদস্য দেশ।
ব্রিটেন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাদের যেমন পৃথক বাণিজ্যিক চুক্তি আছে তেমনি বাকি দেশের সঙ্গেও হতে পারে।
প্রায় তিন বছর আগে ব্রিটিশ জনগণের গণভোটে দেওয়া রায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেন। সেই প্রক্রিয়ার নামই হচ্ছে ব্রেক্সিট। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি রাত ১১ টায় ‘ব্রেক্সিট’ কার্যকর করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায় ব্রিটেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হয় ব্রেক্সিট বিল। এই বিচ্ছেদ কার্যকরী করতে বেশ কিছু শর্ত নিয়ে ব্রেক্সিট বিল পাস হওয়ার আগে ইইউ’র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন বরিস জনসন।
ওই চুক্তির শর্ত মানতে বাধ্য দু’পক্ষই। এখন ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ইইউ’র সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে ব্রিটেনের।
এবার একতরফাভাবে ‘ব্রেক্সিট চুক্তি’তে বদল ঘটাতে চাইছেন জনসন। এরপর রীতিমতো ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ভাবনা শুরু করেছে ইইউ।