সিরাজুর রহমানঃ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কোনো জাতির সার্বিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে বাস্তব জীবন কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থা। আর বর্তমানে এদিক থেকে বিশ্বের সবকটি জাতি থেকে পিছনে পড়ে রয়েছে মুসলিম জাতি এবং ইসলামিক বিশ্বের দেশগুলো। এখন সারা বিশ্বে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর লোক সংখ্যা মোট প্রায় ১৭৮ কোটির কাছাকাছি হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো বিশ্বের দরবারে নিজেদের যোগ্য স্থান করে নিতে পারছে না।
বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে প্রায় ১.১০ বিলিয়ন, আফ্রিকায় ৪৪০ মিলিয়ন, ইউরোপে ৫০ মিলিয়ন এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে মোট ৭.১০ মিলিয়নের কাছাকাছি মুসলিম জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে। আর সারা বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন মুসলিম নাগরিক। একজন হিন্দুর বিপরীতে দুইজন এবং একজন বৌদ্ধের বিপরীতে প্রায় দুইজন মুসলমান আছে এই পৃথিবীতে।
সংখ্যাগত বিচারে সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্মের লোক সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হওয়া সত্ত্বেও তারা আজ কিন্তু একটি দূর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে যুদ্ধ কিংবা সামরিক সংঘাতে যত জন লোক মারা যায় কিংবা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাদের ৯০% পর্যন্ত কিন্তু কোন না কোন ভাবেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী বা মুসলিম জাতিগোষ্ঠির লোক।
পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারি লোকসংখ্যা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও তার কেন এত দুর্বল বা পিছিয়ে রয়েছে? এর মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়, ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট ওআইসি এবং অন্য মুসলিম দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণামুলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজারের কাছাকাছি। অর্থ্যাৎ প্রতি ২০ লক্ষ মুসলমানের জন্য রয়েছে একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য দিকে আমেরিকায় কিনা এই সংখ্যা ৫,৮০০টি।
প্রতি বছর বৈশ্বিক পর্যায়ে সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর যে র্যাংকিং করা হয়, সেই তালিকায় হাজারের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয় আসলেও এ দেশগুলোর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু প্রথম সারিতে স্থান পায় না। তাছাড়া ভিন্ন এক গবেষণামুলক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খ্রিষ্টান ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষার হার ৯০% এবং ১৫টি উন্নত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের শিক্ষার হার গড়ে ১০০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদিক বিবেচনায় সারা বিশ্বের কোন মুসলিম দেশের শিক্ষার হার ১০০% দেখা যায় না।
ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার হার গড়ে ৯৮% পর্যন্ত হলেও মুসলিম দেশগুলোতে এই হার গড়ে ৬০% এর নিচে। আবার উচ্চ শিক্ষায় খ্রিষ্টান দেশগুলোর শিক্ষিতের হার ৪২% হলেও তা আবার মুসলিম বিশ্বে মাত্র ৮%। এদিকে আবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থয়ী ৫টি সদস্য দেশের মুসলিম বিশ্বের কোন দেশই আজো নিজের যোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি।
উন্নত ইসলামিক দেশগুলোতে প্রতি ১০ লাখ মুসলমানের মধ্যে আনুমানিক ৩০০ জন বিজ্ঞানী ও গবেষক। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর সংখ্যা ৪ হাজার এবং জাপানে প্রতি ১০ লক্ষে ৫ হাজার জন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। পুরো আরব বিশ্বে আনুমানিক ৩৫ হাজার বিজ্ঞানী ও গবেষক রয়েছেন। তার মধ্যে শুধু আরবে প্রতি ১০ লক্ষে ৫০ জন আর খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলোতে এর সংখ্যা প্রতি ১০ লক্ষে ১ হাজার জন বিজ্ঞানী ও গবেষক রয়েছেন। আর মনে করা হয় মাত্র ৯১ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ ইসরাইলে বিভিন্ন সেক্টরে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি।
মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো গবেষণায় এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গড়ে ব্যয় করে মোট জিডিপি’র মাত্র ০.৫% থেকে ১% পর্যন্ত। যেখনে চীন, জাপান, ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলো তাদের মোট জিডিপির ৩% থেকে ৫% পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে শিক্ষা, বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে। আর এ থেকে বোঝা যায় মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো আধুনিক শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কতটা পিছিয়ে রয়েছে।
জ্ঞান বিকাশের বড় দু’টি মাধ্যম পত্রিকা ও গ্রন্থ। মুসলিম বিশ্বে প্রতি এক হাজার জনে একজন সংবাদপত্র পড়ে আর প্রতি ৫ লাখ লোকের মধ্যে একজন গ্রন্থ পড়ে। এ থেকে আরো স্পষ্ট বোঝা যায়, মুসলিমরা জ্ঞানবিকাশ কোন পর্যায়ে রয়েছে।
আবার মোট রফতানিতে প্রযুক্তি নির্ভর ইলেকট্রনিকস পণ্যের সংখ্যা জ্ঞান প্রয়োগের একটি বড় নিদর্শন। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির আনুমানিক ৩% পর্যন্ত এবং পাকিস্তানের মোট রফতানির ২% প্রযুক্তি নির্ভর ইলেকট্রনিক পণ্য ও সেবা হয়ে থাকে। তাছাড়া সৌদি আরবে ০.৫%, কুয়েত, মরক্কো এবং আলজিরিয়াতে ০.৫ শতাংশ এ খাত থেকে আয় আসে। অথচ জাপানের মোট রপ্তানির ৭০% প্রযুক্তি নির্ভর ইলেকট্রনিক্স পন্য, চীনের মোট রপ্তানি পন্য ৬০% এবং সিঙ্গাপুরে ৫৮% বা তার কাছাকাছি হয়ে থাকে। এই রফতানি সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসরতা কতটা নিচে।
আবার ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট ওআইসি’র জোটভুক্ত দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কম। অন্যদিকে, শুধু আমেরিকার বার্ষিক জিডিপির পরিমাণ ২১ ট্রিলিয়ন ডলার, চীনের ১৭ ও জাপানে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরান, কুয়েত ও কাতারের জিডিপি একত্রে ২ ট্রিলিয়ন ডলার ডলার। স্পেনে ১.০০ ট্রিলিয়ন ডলার এবং থাইল্যান্ডে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এ সমীক্ষা থেকেই বোঝা যায় যে, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর উচ্চ শিক্ষার অভাবে পিছিয়ে আছে সব দিক থেকেই।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ শিক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে গেলেও আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর একটি বড় অংশ আজো চরম দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে এবং এ দেশগুলোর শিক্ষার হার ও মান কোন পর্যায়ে রয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বেশ কিছু দেশে প্রায় তিন দশক ব্যাপী এক দীর্ঘ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং এই অঞ্চলে প্রভাবশালী দেশগুলো আজ কে কার শত্রু কিংবা বন্ধু তা অনুমান করাটা বেশ কঠিন একটি বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে।
সুবিশাল মুসলিম জনসংখ্যার ৬০ এর কাছাকাছি ইসলাম ধর্ম প্রধান দেশে ৩ হাজারের কাছাকাছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণামুলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও এগুলো কার্যত ইসলামিক দেশগুলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই রাখতে পারছে না। তাছাড়া এখনো পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব কিন্তু তার প্রযুক্তিগত চাহিদা লাঘবে প্রাচ্য এবং প্রাশ্চাত্যের উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রয়েছে। সোজা কথায় বলতে গেলে মুসলিম বিশ্বের প্রায় ৯৫% দেশই আজ অব্ধি প্রযুক্তির জন্য কোন না কোন ভাবেই অন্য দেশের উপর সরাসরি নির্ভরশীল।
তাই এক বিংশ শতাব্দীতে এসে তুরস্ক, ইরান, মালেয়শিয়া, বাংলাদেশ কিম্বা ইন্দোনেশিয়ার মতো বেশ কিছু মুসলিম দেশ শিক্ষা, অর্থনৈতিক এবং স্বল্প পরিসরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও বাস্তবিক অর্থে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলোর পর্যায়ে কিছু করার কিংবা প্রভাব বিস্তারের মতো যথেষ্ঠ সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ঠ অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।