১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ – গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন তুঙ্গে, লাখ লাখ মানুষ জয় বাংলা ধ্বনিতে শাহবাগে এসে জড়ো হচ্ছে ফাঁসির দাবীতে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না, বিতর্কিত করা যাচ্ছে না। লাশ দরকার লাশ। বেছে নেয়া হলো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী স্থপতি ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে, খুন করা হলো তাকে। ধর্মের বিরুদ্ধে তার লেখা ব্লগগুলো ছড়িয়ে দেয়া হলো বারুদের মতো।
বুদ্ধিজীবী মহল ও শিক্ষিত ফেসবুকার এক নাস্তিকের সেসব লেখা পড়ে বললো,
“হত্যা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত এভাবে গালাগালি করা ঠিক নয়, যৌক্তিক সমালোচনা করলেই পারতো। এভাবে অনুভূতিতে আঘাত দিলে তো কোপাবেই।”
এক রাজীব হায়দারের কারণে রাতারাতি মঞ্চ বিতর্কিত হলো, মানুষের কাছে মঞ্চ নাস্তিক হয়ে গেল। মঞ্চের মুসলমানিত্ব রক্ষায় নাস্তিক রাজীব হায়দারের জানাযা পড়ানো হলো ইমাম ডেকে। কিন্ত মঞ্চের মুসলমানিত্ব রক্ষা পেয়েছিল কি?
মৌলবাদ আরও শক্তিশালী হলো।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ – বইমেলা(বর্তমান কিতাব মাহফিল) থেকে বের হওয়ার সময় খুন হলেন বুয়েটের সাবেক প্রকৌশলী ডঃ অভিজিত রায়। হাজার হাজার প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, কিন্ত কখনও কোথাও গালাগালি করেননি। সবগুলো প্রবন্ধ, সবগুলো বই বৈজ্ঞানিক রেফারেন্সসহ যুক্তি নিজের জ্ঞান নিজের দর্শন উত্থাপন করেছেন।
বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আবার কলম ধরলেন এবার আর গালাগালির কথা বললেন না, বললেন, “হত্যা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত ধর্মের সমালোচনা করতে হবে কেন? নাস্তিকেরা অনুভূতিতে আঘাত দিলে কোপ খাবেই।”
মৌলবাদ আরও শক্তিশালী হলো।
৩০ মার্চ, ২০১৫ – ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ১২ মে, ২০১৫ – অনন্ত বিজয় দাশ। ৭ আগস্ট, ২০১৫ – নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। বুদ্ধিজীবীরা আবারও কলম ধরলেন, “সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত…”
মৌলবাদ আরও শক্তিশালী হলো।
৩১ অক্টোবর, ২০১৫ – জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফীন দীপনকে আজিজ মার্কেটে হত্যা করা হলো। এতদিন লেখক মারা হয়েছে, এবারে প্রকাশকের পালা। মৌলবাদীদের অপছন্দের বই প্রকাশের অপরাধে খুন হলেন প্রকাশক।
বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত ফেসবুকাররা আবারও কলম ধরলেন, “সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত এসব বই কেন ছাপাবে…”
মৌলবাদ আরও শক্তিশালী হলো। বিভিন্ন প্রগতিশীল বই ছাপানো ও প্রকাশ করা বন্ধ করে দিলেন প্রকাশকেরা। কিতাব মাহফিলে পুলিশ ও হুজুরেরা এখন ঠিক করেন কোন বই ছাপা হবে কোন বই হবে না।
২৬ জুন, ২০১৬ – LGBT কর্মী জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বি তনয়কে হত্যা করা হলো, যারা লেসবিয়ান গে বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার ও অন্যান্য মানুষদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন।
বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিতগোষ্ঠী আবারও কলম ধরলেন, তারা প্রমাণ করলেন এসব সমকামী কর্মকাণ্ড অবৈজ্ঞানিক অসামাজিক অপ্রাকৃতিক কাজ, সাথে এটাও উল্লেখ করলেন যে হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। তারা বললেন, “হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত সমকামিতা অবৈজ্ঞা…”
মৌলবাদ আরও শক্তিশালী হলো। মৌলবাদ ফ্রাংকেন্সটাইন হয়ে উঠলো। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল ও শিক্ষিতগোষ্ঠী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বছরের পর বছর ধরে তৈরি করলো।
মৌলিবাদীরা এখন নিজের ছাড়া সবার কল্লা চায়। “হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত…” বলতেন যেসব বুদ্ধিজীবী মৌলবাদীরা এখন তাদেরও কল্লা চায়।
মোশাররফ করিমকে ক্ষমা চাইতে হলো, কারণ মৌলবাদীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগসে। হিউম্যান মিল্ক ব্যাঙ্ক বন্ধ করতে হলো, কারণ মৌলবাদীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগসে। বিদ্যানন্দের প্রধানকে সরে যেতে হলো, কারণ অনুভূতিতে আঘাত লাগসে। অজস্র কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অজস্র উদ্যোগ মুখ থবরে পড়সে, অজস্র মানুষ ক্ষমা চাচ্ছে, কারণ মৌলবাদীদের আঘাত লাগসে।
আজকে আয়মান সাদিক প্রাণভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ সে নাস্তিক নয় সমকামী নয়, এসবের প্রমোটারও নয়। সব ডিলিট করে লাইভে এসে নিজেকে মুসলমান করেও লাভ হচ্ছে না। আজ আর বুদ্ধিজীবীরা কলাম লিখছেন না, আজ আর শিক্ষিত ফেসবুকাররা লিখছেন না, “হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত…”
কারণ সবাই বুঝে গেসে এবার কাদের পালা। যেসব শিক্ষিত লোকেরা এতদিন ভিন্ন মতাধর্মীদের খুন জাস্টিফাই করে এসেছেন, চাপাতিটা এবার তাদের ঘাড়ের উপরেই ঝুলছে। এবার সবার পালা। যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সবাই মিলে দুধকলা দিয়ে বড় করেছে, সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এখন কাউকে ছাড়বে না।
শেষ করি মার্টিন নিম্যোলারের সেই বিখ্যাত কবিতা দিয়ে –
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না,
কারণ,
কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।”
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের আলাদা মত থাকতে পারে, কিন্ত প্রতিটি মত স্বাধীনভাবে প্রকাশের জন্য সবাইকে একসাথে লড়তে হবে। নাহলে যখন আপনার সিরিয়াল আসবে তখন কথা বলার মতো কেউ আর বেঁচে থাকবে না।
যেদিন শিক্ষিত প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী “হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্ত…” এর বদলে “আমি তার সাথে একমত নই, তবুও আমি তার মত প্রকাশের নিরাপত্তা চাই” লিখতে শিখবে, সেদিন মৌলবাদের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দুর্বল হবে, তার আগে না।
লেখকঃ সমিত জামান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।