শিশু পর্নোগ্রাফিতে সম্পৃক্ততার দায়ে একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ প্রাসঙ্গিক তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশের কাছে। পুলিশের সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টগেশন ডিভিশন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
গত ১৫ অক্টোবর আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, বোরহান উদ্দিন এবং অভি হোসেন নামের খ্যাতনামা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন স্নাতককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। পুলিশ বলছে, অকাট্য প্রমাণ হাজির করার পর তাঁরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে দোষ স্বীকার করেন। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হলে ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে এই তিনজনের।
গ্রেপ্তার তিনজন নিজেদের মেয়ে ও সমকামী বলে ইনস্টাগ্রামে পরিচয় দিতেন। তাঁরা শিশুদের অতিগোপনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করতেন।
সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মেয়ে শিশুদের পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট উদ্ধার হয়। যে ৩০ জিবি কনটেন্ট উদ্ধার হয়েছে, তার সবটুকু এখনো যাচাই–বাছাই করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ফোল্ডারে কনটেন্টগুলো রয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনটি ফোল্ডারে অস্ট্রেলীয় শিশুদের অতি গোপনীয় ছবি রয়েছে। কমপক্ষে দুটিতে আছে যুক্তরাজ্যের শিশুদের। এখন পর্যন্ত তিন–চারজন বাংলাদেশি শিশু ঘটনার শিকার হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মূলত, এই প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ বাংলাদেশের পুলিশ সদর দপ্তরের কাছ তথ্য চেয়েছে। এর বাইরেও আরও কয়েকটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে। বাংলাদেশ দেশগুলোকে আশ্বস্ত করেছে, আসামিরা গ্রেপ্তার আছেন এবং সঠিক তদন্ত হবে।
সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন জানায়, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শিশু তাদের হয়রানির শিকার হওয়ার খবর জানায়। শিশুটি ইন্টারনেটের খুঁটিনাটি জানে এবং নিজেই আবিষ্কার করে তাকে ঢাকা থেকে হয়রানি করা হচ্ছে। এরপর ফেসবুকে সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ওয়েবপেজে অভিযোগ করে। সে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অবহিত করে। পুলিশ অভিযোগকারী ও মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে।
পুলিশ বলছে, এই মুহূর্তে শিশুদের সুরক্ষা সারা বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে। বাংলাদেশের পুলিশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিল্ড্রেন (ইকমেক) নামে একটি সংগঠনের সদস্য। ইকমেকের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তথ্য আদান–প্রদান করছে।
ঠিক কীভাবে শিশুদের প্রতারণা করে আসছিলেন ওই তিন তরুণ? তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তার তরুণেরা নিজেদের মেয়ে ও সমকামী বলে ইনস্টাগ্রামে পরিচয় দিয়েছিলেন। চক্রটির প্রধান বোরহান উদ্দীন। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই বোরহান শিশুদের অতিগোপনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করতে শুরু করেন। শিশু পর্নোগ্রাফি–নির্ভর বেশ কটি দলের সদস্যপদ ছিল বোরহানের। এরপর বোরহানের সঙ্গে যোগ দেন চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন। দুই ভাই মিলে এরপর শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা করতে শুরু করেন। অভি হোসেন মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যে দলের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন। নাম নিবন্ধনের পর এ দলভুক্ত হতে হয়। ওই দলেও তিন–চারজন শিশুর উপস্থিতি শনাক্ত করেছে পুলিশ। তারা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন আরও কয়েকটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সন্তান ইন্টারনেট কী কাজে ব্যবহার করছে, তা নজরদারি করার অনুরোধ জানিয়েছে। তারা আশঙ্কা করছে, এই চক্রে বা ভিন্ন কোনো চক্রে আরও কেউ কেউ যুক্ত থাকতে পারে। মামলাটি এমনভাবে করা হয়েছে, যেন আর কেউ গ্রেপ্তার হলে তাঁকেও মামলায় আসামি করা সম্ভব হয়।
ইউনিসেফের হিসাবে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ডিজিটাল হয়রানির শিকার হওয়ার মতো ঝুঁকিতে আছে। শিশুদের একটি বড় অংশ তাদের শোবার ঘরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, এতে সহজেই তারা নজরদারি এড়াতে পারে। তারা মূলত চ্যাট করে ও ভিডিও দেখে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে।