মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করা এবং সৌদি আরব, ইসরাইল ও তুরস্কের মতো উদীয়মান দেশগুলোকে কৌশলে ঘায়েল করা। ইরান চায় মধ্যপ্রাচ্যে একক আধিপত্য বজায় রাখতে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে ইরান তার সহযোগী দেশ সিরিয়া, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথী মিলিশিয়া এবং অন্যান্য সামরিক সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে এক ও অভিন্ন জোট গড়ে তুলতে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে যাচ্ছে। তবে ইরান তার এই অবাস্তব স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিলিয়ন ডলারের অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র যোগান দিয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য এবং সামরিক উপস্থিতি বজায় থাকায় ইরানের সার্বিক নিরাপত্তা এখনো অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। ইরান চাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে একক আধিপত্য বিস্তার করে ভবিষ্যতে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। যেটা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসররা কৌশলে করে যাচ্ছে।
তাছাড়া ২০১৫ সাল থেকে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে রাশিয়ার পাশাপাশি ইরান সরাসরি সিরিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর যুদ্ধ শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঠিক কতজন ইরানী সেনা, হিজবুল্লাহ, স্বেচ্ছাসেবক ইরানী নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছেন তার সঠিক কোন তথ্য জানার বা পাওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সিরিয়ায় হতাহত ইরানী সেনাদের নিয়ে তাদের নিউজ সাইটগুলো আজ পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এমনকী ইরানের সরকার দেশের জনগণের কাছে কিংবা পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য উপাত্ত উপাস্থাপন করেছে এমন কোন নজির আছে বলে মনে হয় না।
অথচ ইসরাইল প্রায় প্রতি মাসেই সিরিয়ায় থাকা ইরানী ও হেজবুল্লাহর সামরিক ঘাঁটি, অস্ত্র গুদাম ও আস্তানা বেছে বেছে নিয়ে এক রকম নিয়মিতভাবেই বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব ইসরাইলের বিমান হামলায় কোন ইরানী হতাহত হচ্ছে না তা আশা করাটা এক রকম বোকামী। এমনও দেখা গেছে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সিরিয়ায় কোন গোপন ঘাঁটিতে থাকা রাডার সিস্টেম, ইরানী সেনার অস্ত্র গুদামসহ সম্পূর্ণ সেনা ঘাঁটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিমান হামলায় ঠিক কতজন ইরানী সেনা হতাহত হয়েছেন তা গোপন করে দেশটির সরকার ও মিডিয়া কার্যত নিজ দেশের জনগণকেই এক গভীর অন্ধকারে রেখেছে। সিরিয়ায় কাজ করা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং যুদ্ধ সংশ্লিষ্ঠ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেব মতে, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে এ পর্যন্ত আনুমানিক ১০ হাজারের কাছাকাছি ইরানী-হিজবুল্লাহ সেনা এবং স্বেচ্ছাসেবক মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ ইরানের নিউজ সাইটগুলো আজ পর্যন্ত এ নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এমনকী সিরিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণকারীর শবদেহ ইরানের সরকার তার পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছে না বিশ্বের সামনে এহেন খবর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। তাছাড়া সিরিয়ায় মৃত্যুবরণকারী ইরানী সেনার দেহ ফিরে পেতে পরিবার ও স্বজনরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ-মিশিলের করলে তা শক্ত হাতে দমন করে ইরানের বিপ্লবী আল খোমেনী সরকার। তবে ইরানের সেনার বেশ কয়েকবার ইসরাইলের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শক্ত জবাব দেবার চেষ্টা করলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এর আগে ইসরাইলের বিমান হামলার পাল্টা জবাবে ইরান তার কথিত বেশ কিছু সংখ্যক অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের দিকে ছোঁড়ে। তবে হাস্যকর হলেও সত্য যে, অত্যন্ত শক্তিশালী এসব ক্ষেপুণাস্ত্রের বেশ কিছু সিরিয়ার সীমানা পাড় না হতেই গোলান মালভূমির কাছে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায়। আর কিছু গোলান মালভূমি পেড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং খুব সম্ভবত দুটি ক্ষেপনাস্ত্র ইসরাইলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সরাসরি ইন্টারসেপ্ট করে। এই হলো সিরিয়া যুদ্ধের বাস্তবতা। নিজের দেশের উন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে এবং দেশের জনগণকে বঞ্চিত করে সিরিয়া এবং ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতে উঠে ইরানের আল খমেনী সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছে বলে মনে হয় না। সৌদি আরব, ইরান এবং তুরস্কের মতো দেশগুলোর মধ্যপ্রাচ্যে ত্রিমুখী সংঘাত এবং প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা গোটা মুসলিম বিশ্বকে এক গভীর অন্ধকারের মুখে ফেলে দিয়েছে।
এখন ইরানের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা একঊ পর্যালোচনা করা যাক। ইরান আসলে ইতোমধ্যেই মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের শতাধিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়ে ভয়াবহ ধরণের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সরাসরি বিরুপ প্রভাব পড়েছে ইরানের প্রধান আয়ের উৎস তেল রপ্তানি খাতে। দেশটির মোট রপ্তানির ৫৬% পর্যন্ত তেল থেকে আসলেও ২০২০ এসে তা ৪০% এর নিচে নেমে গেছে। আর তারই ধারবাহিকতায় এক বছরে ইরানের তেল রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০১৯ সালের সমাপ্তি বছরে ইরানের জিডিপি (মাইনাস) -৬% এ পৌছে যায় এবং দেশের অভ্যন্তরীন মূল্যস্ম্ফীতি প্রায় ৪০% এসে ঠেকে। ২০২০ এর নতুন বছরের এক হিসেব অনুযায়ী এক ডলারের বিপরীতে প্রায় ৪২,১১০ ইরানী রিয়াল গুনতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণকে। যা টাকার হিসেবে ১ টাকার বিপরীতে ৫০০ ইরানি রিয়াল ধার্য্য করা হয়। তাছাড়া দেশটির প্রায় ৪ হাজারের কাছাকাছি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কল কারখানা ইতোমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুপ প্রভাবে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে কিম্বা ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। তাছাড়া ইরানে বৈদেশিক বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় বিশ্বের কোন দেশের সাথেই ভালো ভাবে বানিজ্য করার সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে হয় না।
যদিও এখানে আসলে সত্যিকার অর্থে বড় ধরণের কোন যুদ্ধে জড়ানোর ইচ্ছা ট্রাম্প বাহিনীর আদৌ আছে কিনা সন্দেহের যথেষ্ঠ অবকাশ থেকেই যায়। তাছাড়া সৌদির পক্ষে একা কারো সাথে যুদ্ধ করার কোন ক্ষমতা নেই। তাই এখানে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন কার্যত ব্যাপক মাত্রায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক আগ্রাসনের ভীতি প্রয়োগ করে ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করার কূট কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে আবারো নতুন করে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরানসহ একাধিক বাদশা ও আমীর শাসিত নির্বোধ দেশগুলোকে শত বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য করবে কিম্বা অত্যন্ত গোপনে নির্বিচারে বিলিয়ন ডলারের চাঁদাবাজি চালিয়ে যাবে, তা হয়ত বিশ্ব সমাজ কোন দিনই জানতে পারবে না।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com