এই যে এত মানবন্ধন হলো, সমাবেশ-প্রতিবাদ মিছিল হলো, মামলা করে শরীয়ত বয়াতীকে জেলে নেয়া হলো, এর মাঝখানে কেউ কিন্ত তার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে এগিয়ে এলেন না।
হাতকড়া পরিয়ে দুজন পুলিশের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একজনকে, লোকটা বাউল, গান গাওয়াটা তার পেশা এবং নেশা। তার দশ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ, তার নামে মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, অভিযোগ, তিনি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন, নবী দাউদ (আ) কে নিয়ে কটু কথা বলেছেন!
নাম তার শরীয়ত সরকার, লোকে তাকে ডাকে শরীয়ত বয়াতী নামে। তবে অনেকের মতে, তিনি করেছেন শরীয়ত বিরোধী কাজ। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে ধামরাইয়ে এক পালাগানের আসরে শরীয়ত সরকার বলেছিলেন- “গান-বাজনা হারাম, এটা কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। কেউ যদি হারাম প্রমাণ দিতে পারে তবে তাকে আমি ৫০ লাখ টাকা দিব এবং সারাজীবনের জন্য কবিগান ছেড়ে দেব”।
তার সেই বক্তব্য ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে, কিছু লোকজন তাকে মুশরিক, কাফের ঘোষণা করে ছড়িয়ে দিয়েছে ভিডিওটা। তাকে গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন আর সমাবেশও হয়েছে! নুন আনতে পান্তা ফুরানো একজন বাউল শিল্পী হঠাৎই চায়ের দোকানের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেলেন, পরিণত হলেন ‘তৌহিদি জনতার চোখে সবচেয়ে বড় খলনায়কে! অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশও তার নামে মামলা নিয়েছে, তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের আবেদন করেছে। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুরও করেছে।
কে জানে, রিমান্ডে যাওয়ায় শরীয়ত বয়াতী হয়তো প্রাণে বেঁচে গেছেন, নইলে চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে তার লাশটা পড়ে থাকতে পারতো যেখানে সেখানে! ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি’র শাস্তি দেয়ার জন্যে এদেশের কিছু মানুষ তো সারাক্ষণই তিন পায়ে খাড়া হয়ে থাকে। ব্লগার থেকে শুরু করে আরও অনেককেক এভাবে কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশে, শরীয়ত বয়াতি চাইলে নিজেকে তাদের চেয়ে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে এত মানবন্ধন হলো, সমাবেশ-প্রতিবাদ মিছিল হলো, মামলা করে শরীয়ত বয়াতীকে জেলে নেয়া হলো, এর মাঝখানে কেউ কিন্ত তার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে এগিয়ে এলেন না। ইসলামে গান কেন নিষিদ্ধ, আসলেই এটা নিয়ে কোরআন কী বলছে, সেসবের রেফারেন্স তুলে ধরতে দেখা গেল না কাউকে। যুক্তি দিয়ে কেউ দাবী করলেন না যে শরীয়ত বয়াতী ভুল বলেছেন, মিথ্যাচার করেছেন। একদল লোক শুধু এক সুরে হুক্কা হুয়া করে গেল, ধর্ম অবমাননা হয়েছে, ধর্মের অপমান হয়েছে! কীভাবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে- সেই ব্যাখ্যাটা কেউ দিলো না!
ধর্ম অবমাননাই যদি মূল বিষয় হয়, তাহলে ওয়াজ-মাহফিলের নামে রাত বারোটার সময় গলার রগ ফুলিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে চিৎকার করতে থাকা ধর্মান্ধ কিছু মানুষের তো আরও আগে জেলের ভাত খাওয়া উচিত ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল জায়গা জুড়ে নিজের আশ্রম খুলে বসে মুরিদদের নিয়ে ধর্মের বারোটা বাজানো কিছু মানুষের রিমান্ডে যাওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। নিজের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, অন্য ধর্মকে আক্রমণ করে যারা আসর গরম করে, তাদের বিরুদ্ধে কেন কেউ মামলা করে না? নাকি এদেশে ধর্মানুভূতির একচ্ছত্র অধিপতি কেবল মুসলমানেরা? অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতি থাকতে নেই?
অবশ্য, যে দেশে লালন ভাস্কর্য ধর্মান্ধদের আক্রোশের শিকার হয়, বাউলের প্রতিমূর্তির ওপরে আঘাত আসে বারবার, পাথরের ভাস্কর্য হয়েও কঠোর আপত্তি ওঠে সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়ানো লেডি জাস্টসকে নিয়ে- সেদেশে ধর্মান্ধদের এমন উগ্র আস্ফালনে একজন বাউল জেলে যাবেন, রিমান্ডের ঘানি টানবেন- এতে অবাক হবার কী আছে! গান-বাজনার ওপরে তো এক শ্রেণীর মানুষের আদিম আক্রোশ আছে। অথচ তারা জানে না, স্বয়ং নবীজি (সা) কবিতা আবৃত্তির কত বড় ভক্ত ছিলেন।
সাহাবী হাসান ইবনে সাবেত (রাঃ) ছিলেন একজন কবি, নবীজি ভীষণ পছন্দ করতেন তাকে। যখন কুরাইশরা তাদের শক্তিশালী কাব্য দিয়ে মুসলিমদের আক্রমন করতো, নবী (সঃ) তখন বলতেন, “কোথায় হাসান? এগিয়ে যাও তোমার কবিতা নিয়ে!” নবীজির মৃত্যুর পরে মসজিদে নববীতে একবার হাসান কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, যখন উমার (রাঃ) ছিলেন খলিফা। তিনি এসে হাসানকে তিরস্কার করে বলেন, “তুমি নবীর মসজিদে কবিতা পাঠ করছো?” হাসান (রাঃ) জবাবে বলেছিলেন- “আমি তখনও এই মসজিদে এই কাজ করতাম যখন এই মসজিদের ইমাম তোমার চাইতেও উত্তম লোক ছিলেন (স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)।” উমার (রাঃ) এরপরে আর কখনই হাসানকে কিছু বলেননি এ ব্যাপারে।
এসবের রেফারেন্স কেউ টানবে না। কে জানে, এই ধর্মান্ধরা হজরত উমরের জায়গায় থাকলে হয়তো কাব্যচর্চার অভিযোগে হাসান ইবনে সাবেতকে ফতোয়া দিয়ে পাথর মেরে হত্যাই করে ফেলতো! ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি করে বেড়ানো মানুষে ভর্তি এই সমাজে এগুলোই তো নিয়তি। নিরাব্বই পার্সেন্ট ফাউল মানুষের দেশে একজন বাউল জেলে যাবেন, রিমান্ডে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক!