চীনে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ভয়ঙ্কর এবং মহামারী আকার ধারণ করেছে এবং তা আস্তে আস্তে সারা বিশ্বকে গ্রাস করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে চীনে এ মুহুর্তে ঠিক কতজন লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন তার সঠিক কোন তথ্য উপাত্ত জানা সম্ভব না হলেও বাস্তবে মৃত্যের সংখ্যা অনেক আগেই তিন হাজারের সীমাকে অতিক্রম করেছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর থাবায় গোটা চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ মুহুর্তে চীনের সাথে সারা বিশ্বের আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ায় ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দারর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে বিগত তিন মাসে চীনের আর্থিক ক্ষতি এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌছে গেছে এবং চীন থেকে আমদানি নির্ভর বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো শতাধিক দেশের শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা নজিরবিহীনভাবে মুখ থুবরে পড়ছে।
আসলে বিগত চার দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আকার এবং শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলেও আমরা কার্যত শিল্পের কাঁচামাল, মুলধনী যন্ত্রপাতি এবং খুচরা যন্ত্রাংশ কিম্বা মেইন্ট্যানেন্সের জন্য চীন কিম্বা অন্য কোন দেশের উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রয়েছি। বিশেষ করে আমাদের অপার সম্ভবনাময় পোশাক এবং ওষুধ খাত শিল্পের কাঁচামালের আমদানির মূল যোগানদার এবং উৎসস্থল কিন্তু চীন। আর এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় চীনের অর্থনীতি বিপর্যস্থ হলে আদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সামগ্রিক শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে বাধ্য। আর যার আলামত কিন্তু ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
চীনের করোনা ভাইরাসের প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য এখন একটি মারাত্বক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এক দিকে করোনার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন যেমন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন, তেমনি ভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চীন থেকে একদিকে যেমন আসছেনা কোন মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং সাজ সরঞ্জাম, তেমনি আসছেনা কোন শিল্পের কাঁচামাল। শেষ হয়ে আসছে চীন থেকে আমদানিকৃত টিভি, ফ্রিজ, এসি, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান, মোবাইল সহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য সামগ্রীর দেশীয় মজুত। তাছাড়া কাঁচামালের জন্য চীন নির্ভর দেশীয় ওষুধ শিল্পও কিন্তু মারাত্বক ঝুঁকির মধ্য পড়তে যাচ্ছে। এদিকে আমাদের দেশে ওয়ান্টনের মতো অনেক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর উৎপাদিত ইলেক্ট্রনিকস পন্য ও সেবা মেইক ইন বাংলাদেশ লেগোতে উৎপাদন করে গেলেও বাস্তবে এসব শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির জন্য অতি মাত্রায় চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু আজ অবধি রপ্তানি শিল্পের ব্যাকাআপ কিম্বা সহায়ক শিল্প ব্যবস্থা কোন ভাবেই গড়ে তুলতে পারিনি এবং এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু সার্বিকভাবেই অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি।
আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত বা বাজারজাতকৃত অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এর বাংলাদেশে রিজার্ভকৃত গাড়ী, মোবাইল, টিভি, এসি -এর সরবরাহেও দেখা দিচ্ছে মারাত্মক ঘাটতি। তার মূল কারণ খরচ কমানোর জন্য এ সকল গ্লোবাল টপ ব্র্যান্ড এবং গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর অনেক সহযোগী কারাখানা কিম্বা ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টগুলো চীনে স্থাপন করা হয়েছে। আর এ জন্যই চীনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় মানে গোটা বিশ্বেরই বিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে।
আবার অন্যদিকে বিশ্বের সেরা অনেক ব্র্যান্ড এর ম্যানিফ্যাকচারিং প্লান্ট বিভিন্ন দেশে স্থাপন করা হলেও এসব শিল্প উতপাদনের প্রয়োজনীয় একসেসোরিজ, যেমন- চার্জার, ম্যানুয়েল বই, রিমোট, ব্যাটারী, ক্যাবল ইত্যাদি চায়নায় তাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাচারিং প্লান্টে উৎপাদিত হয়। ফলে বিশ্বের অনেক নামীদামী ব্রাণ্ড কিম্বা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত শিল্প পন্য মেইড ইন চায়না না হলেও, অনেক বিদেশী ব্র্যান্ডও সামগ্রিক ব্যবসায়ের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
আবার আমাদের দেশের অনেক ব্রাণ্ড মেইড ইন বাংলাদেশ লেগোতে শিল্প পন্য উৎপাদন করলেও তা্রা মুলত ৮০% এমনকী ১০০% পর্যন্ত খুচরা যন্ত্রাংশ, ডিভাইস, কাঁচামাল সরাসরি চীন থেকে আমদানি করে নিজস্ব এসেম্বলী কিম্বা ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে সংযোজন করে নিজ দেশের বাজারে আনছে কিম্বা অন্য কোন দেশে রপ্তানি করে। তাই এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় চীনের কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশের শতভাগ চীন নির্ভর ইলেক্ট্রিক পন্য ও সেবা আমদানিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং সরাসরি চীন থেকে পন্য আমদানিতে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং মারাত্বক সংকট। আর সেই সাথে করোনার আগ্রাসন বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার জন্য চীন আসলে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
লেখকঃ সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও কলামিস্ট, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।