ধর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলনও আজকাল অনেকটা আনন্দ ও বিনোদনের আইটেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুজুগে বাঙ্গালি। আবেগী বাঙ্গালি। কিছুদিন ধুমধাড়াক্কা হইহল্লা করে এক সময় ক্ষান্ত হয়ে পড়ে। নিভে যায় আন্দোলনের অগ্নিশিখা। তলে পড়ে যায় নতুন কোনো বারুদের ভারে। মানুষ ভুলে যায় দ্রুতই সবকিছু। দেশ যেভাবে চলার সেভাবেই চলতে থাকে। অর্থাৎ যেই লাউ সেই কদু।
ধর্ষণের প্রতিবাদে এবার সবাই নড়ে চড়ে বসেছে। মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রাজনৈতিক সংগঠন, যুবসমাজ, সাধারণ জনতা, ছাত্রছাত্রী সহ বিভিন্ন আঙ্গিকের সেলিব্রিটিরাও পিছিয়ে নেই। সাধারণ মানুষ যখন কোনো কথা বলে তা সমাজে তেমন কোনো রেখাপাত করতে পারেনা। কিন্তু সেলিব্রিটি জাতীয় কেউ কিছু বললে তা তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেলে। সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন অভিনেতা অনন্ত জলিল নারীদের অশালীন পোশাকই ধর্ষণের কারন বলে মন্তব্য করলে তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তীব্র সমালোচনা ও আন্দোলনের মুখে টিকতে না পেরে তিনি তার বক্তব্য থেকে সড়ে দাড়ান। বলে দিলেন, ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাক নয়, বরং পুরুষদের বিকৃত মনমানসিকতাই দায়ী।
বছর দুয়েক আগে দেশের অন্যতম টিভি অভিনেতা মোশাররফ করিম একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, “মেয়েরা তাদের ইচ্ছে মতো পোশাক আশাক পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ধর্ষণের কারন পোশাক নয়।” এ কথা সাহস করে তিনি বলে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায়! শুরু হলো তার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড়। অবস্থা বেগতিক দেখে কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য ক্ষমা চাইলেন। বক্তব্য সংশোধন করলেন। বললেন, জনগণ যেভাবে বিষয়টা বুঝেছে প্রকৃত অর্থে সেভাবে তিনি বলেননি। বরং পোশাকের শালীনতায় তিনি বিশ্বাসী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা মোটেও তার অভিপ্রায় নয়। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তিনি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
একজন প্রথমে পোশাকের শালীনতাকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে আন্দোলনের মুখে তার অবস্থান থেকে সড়ে আসেন। অন্যজন মানুষের বিকৃত মনমানসিকতাই ধর্ষণের কারন বলে মন্তব্য করলেও পরিশেষে তিনিও তার অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেননি। আন্দোলনের তোপের মুখে তাকেও অবস্থানচ্যুত হতে হয়। অনেকটা “ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি” অবস্থার মতো। এর কারণটা হলো তারা যা বলেন তা তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেননা। নড়বড়ে বিশ্বাস ও দুর্বল চিত্ত নিয়ে কথা বলার ফলেই তাদেরকে এভাবে সড়ে আসতে হয়েছে। অবস্থানচ্যুত হওয়ার আগের কিংবা পরের যে কোনো বক্তব্যকেই আমরা ধর্ষণের কারন হিসেবে ধরে নেই না কেনো এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে দু বক্তব্যের পক্ষেই জনমত রয়েছে। সুতরাং কোনটা অধিক গ্রহণযোগ্য কিংবা অধিকতর দায়ী অথবা উভয় কনসেপ্টই সমান ভাবে দায়ী কিনা তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ধর্ষণের যে দুটো কারণ মানুষের সামনে এসেছে কিংবা যেগুলোকে নিয়ে তারা নাচানাচি করছে তার আগে সেই কারণ গুলো ঘটার পিছনে কি কারণ রয়েছে তা খুঁজে বের করা আরও বেশি জরুরি। অন্যথায় শাস্তি যতোই ভয়ানক হোকনা কেনো তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। প্রগতিবাদীদের কথা মেনে নিয়ে ধরে নিলাম ধর্ষণের প্রথম কারণ মানুষের বিকৃত মানসিকতা। বিকৃত মানসিকতার কারন কি? কখন মানুষ বিকৃত রুচি বা বিকৃত মন মানসিকতার অধিকারী হয়ে ওঠে? বিকৃত রুচি বা মানসিকতা নিয়ে তো কেউ জন্মায় না। এ সমাজ তাদেরকে বিকৃত করে তোলে। প্রশ্ন উঠে, কিভাবে?
সুস্থ মনের মানুষটি যৌন তাড়নায় কখন উন্মাদ হয়ে উঠে? বিকৃত রুচি কখন এসে তার উপর ভর করে? নগ্নতা, বেলেল্লাপনা, উশৃংখল পোশাক পরিচ্চদ ও আচরণ, খোলামেলা চলাফেরা, মুক্ত যৌনাচার, দেয়ালে দেয়ালে উলঙ্গ পোস্টার, অশ্লীল টেবলয়েড, পত্র পত্রিকা ও বই, নীলছবি, চলচ্চিত্রে অশালীন নাচগান ও ধর্ষণের যৌন উত্তেজক দৃশ্য, অনলাইন ভিত্তিক অশ্লীল সাইট সমূহের অবাধ ছড়াছছড়ি প্রভৃতি কারণে মানুষের মাঝে বিকৃতি দেখা দেয়। এ বিকৃত মন অতি সহজেই ধর্ষণের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
কিছু দিন আগে আমার একটি নিবন্ধে মা সম্পর্কে এক কিশোরের মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বন্ধুদের কাছে মাকে নিয়ে এমন অশালীন মন্তব্য কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে ধরে নিতে হবে ওই ছেলেটি নিশ্চয়ই মানসিক বিকৃত সম্পন্ন ছিলো। কিন্তু তার বিকৃত মানসের পেছনে কি কাজ করেছিলো? তার মা’র অশালীন তথা অর্ধ নগ্ন পোশাকই ছিলো এর কারণ। সুতরাং যারা মানসিক বিকৃতিকে ধর্ষণের একমাত্র কারণ মনে করেন তাদের বুঝা উচিত যে অশালীন পোশাক আশাকই মানসিক বিকৃতিকে ত্বরান্বিত করে। মানসিক বিকৃতিকে তথা আরেকটু সহজ ভাবে বললে বলা যায়, ধর্ষণের হারকে নিম্নগামী করতে হলে অশালীন পোশাককে প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থাৎ অশালীন পোশাকআশাককে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে পারলে মানসিক বিকৃতি কমবে, মানসিক বিকৃতি কমলে ধর্ষণ কমবে।
সাত বছরের শিশু সন্তান বা বোরকাপরা মহিলা ধর্ষিতা হওয়ার কথা বলে যারা মানসিক বিকৃতিকে ধর্ষণের মূখ্য কারন হিসেবে প্রচারণা চালান তাদেরকে বলবো এ ধরনের ঘটনা সমাজে কয়টা ঘটে। কালেভাদ্রে হয়তো দুএকটি ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো ব্যতিক্রম। বিজ্ঞানের কিছু সতসিদ্ধ সূত্রও এমন ব্যতিক্রমের উর্ধ্বে নয়। তাই বলি, অশালীন পোশাক পরিচ্চদ ও মানসিক বিকৃতিকে দায়ী করে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যারা ধর্ষণ দমানোর জন্য আন্দোলন করছেন তাদের আন্দোলন সার্থক হবেনা। এতে ধর্ষণ কমবে না। বরং দুপক্ষকেই এক কেন্দ্রে এসে দাঁড়াতে হবে। একজোট হয়ে আন্দোলন করতে হবে। অশালীনতা ও মানসিক বিকৃতিকে দূর করার জন্য সমাজে জাগরণ তুলতে হবে। দুপক্ষ মিলে এ কাজটি করতে সক্ষম হলে ধর্ষণ অনেকাংশে কমে যাবে। সমাজ উপকৃত হবে।
রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছে। ধর্ষণ ঠেকানোর জন্য সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এ আদেশ বা আইন যেনো কেবল ফাইলবন্দী হয়ে না থাকে সেদিকেও সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে সে আইন বৃথা। উন্নত বিশ্বে ধর্ষণের জন্য বড়োজোর ৮/১০ বছরের জেল হয়। ক্ষেত্রবিশেষ আরও অনেক কম। জেলখানায় থাকার সুযোগ সুবিধা যেনো অনেকটা ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার মতো। নিয়মিত খাবারদাবারের পাশাপাশি আলাদা রুম, টিভি সবই থাকে। বছরে সম্ভবত শর্ত সাপেক্ষে দু সপ্তাহের ছুটিও মেলে। এরপরও সেসব দেশে ধর্ষণের খবর খুব একটা চোখে পড়েনা। এর কারণ কি? কারণ একটাই এসব দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়। যতোটুকু শাস্তি বিধানের নিয়ম রয়েছে তার পুরোটাই যথাযথ ভাবে পালিত হয়।
লেখক: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও কলামিসট
shajed70@yahoo.com