সংবাদমাধ্যমে মাঝে মাঝে দেখা যায়, সেরা ধনীর তালিকা, সেরা খেলোয়াড়ের তালিকা বা সেরা অভিনয় শিল্পীর তালিকা। কিছু দিন ধরে চলছে করোনা (কভিড-১৯) ভাইরাস আক্রান্ত দেশের তালিকা। তবে এই সব তালিকা ছাপিয়ে এখন আলোচনায় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক পাপিয়ার খদ্দেরদের তালিকা। তালিকার প্রসঙ্গটি অবশ্য তুলেছেন সাংবাদিক ও লেখক ফারুক ওয়াসিফ।
খদ্দেরের তালিকা নিয়ে আলোচনার আগে কিন্তু ধনী, খেলোয়াড় বা অভিনয় শিল্পীর তালিকায় পাপিয়াকে খুঁজে দেখা যেতে পারে। দেশে দ্রুত ধনী হওয়া নারীদের শীর্ষ তালিকায় পাপিয়া না থাকার কারণ নেই। যিনি দৈনিক লাখ টাকা হোটেল ভাড়া, ২-৩ লাখ টাকা মদের বিল; সব মিলিয়ে তিন মাসে ৩ কোটি টাকা হোটেল বিল দেন তাকে তালিকার শীর্ষ থেকে নামানোর সাধ্য কার? আর পাকা খেলোয়াড় ছাড়া এত দ্রুত ব্যাট চালাতে পারবে কে? সুন্দরী কেনা-বেচার হাটের মক্ষীরানি হয়ে উঠতে অভিনয় শিল্পের নিখুঁত দক্ষতাও লাগবেই। এতসব গুণ যার মধ্যে আছে তিনি আজ ভিলেনের তালিকায়!
কিছু দিন আগে এক সম্রাটের মুকুট কেঁড়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু মুকুট তো খালি থাকার জিনিস নয়।
তাই এক সম্রাট নিস্তেজ হলেও অপর সম্রাটরা মুকুট সুউচ্চ রেখেছেন। পাপিয়ার সাম্রাজ্য থেকেই সেটা পরিস্কার হওয়া গেল। সম্রাটের মুকুট কখনো পুরুষ সম্রাটের মাথায় থাকে, আবার কখনো নারী সম্রাটের (সম্রাজ্ঞী)। সম্রাটের পতন হলেও তার উপদেষ্টা পরিষদের টিকিও কেউ নাড়াতে পারেনি। সে কারণেই হয়তো পাপিয়াদের পাপাচারের স্রোত বহমান। কারণ, ঘুরে ফিরে তারা একই পথের পথিক। একই উপদেষ্টাদের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা।
সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে তাতে সম্রাটের সঙ্গে পাপিয়ার এক বড় পার্থক্য রয়েছে। সম্রাটের রাজ্যে যারা টাকা ওড়াতে যেত তারা স্বেচ্ছায় যেত। জবরদস্তি ছিল না। পাপিয়ার এখানেও স্বেচ্ছায় যাওয়ার বিষয় রয়েছে। কিন্তু মধুচক্রের ফাঁদে একবার পা রেখে যারা জিম্মি হয়েছে তাদের কী হাল হয়েছে তা হয়তো লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যাবে। গোপন ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইল করার যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে বোঝা যায়, যারা গিয়েছিলেন তারা স্বেচ্ছায় ফাঁদে পা দিয়েছেন, কিন্তু আর বের হতে পারেননি।
তবে সবচেয়ে বড় ও বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে পাপিয়া চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের জোর করে খদ্দেরের কাছে পাঠাতেন। খদ্দেরের ভিডিও যখন করা হয়েছে তখন ওইসব ভিডিওতে তরুণীদেরও ভিডিও রয়েছে তা অনুমেয়। বিষয়টি বেশ ভয়ঙ্কর। পাপিয়ারা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ না অসৎ, ধনী না গরিব, কী খায় বা কী পরে তা দিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন চাকরি প্রার্থী তরুণীদের জিম্মি করে খদ্দেরের বিছানায় পাঠায় তখন সবারই মাথাব্যথা হওয়া উচিৎ।
একজন শিক্ষিত তরুণী স্বাভাবিকভাবেই একজন চাকরিদাতা নারীর কাছে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আবার কোনো উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী নারীকে আমরা বেশি সম্মানের সঙ্গে দেখি।
পাপিয়া এই দু’টি যায়গার বিশ্বাসে এক বিরাট ফাটল ধরিয়েছে। আমাদের তরুণীরা এখন চাকরি চাইতে নিরাপদ বোধ করবে কার কাছে? কীভাবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাইভা দিতে যাওয়ার সাহস করবে? অন্যদিকে এ ঘটনায় সৎভাবে পরিশ্রম করে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা বা ধনী হওয়া নারীরা বিব্রত বোধ করতেই পারেন।
এজন্য সম্রাটের ইতিহাস আর পাপিয়ার ইতিহাস একটু ভিন্নভাবেই রচিত হওয়া প্রয়োজন। পাপিয়া পাপরাজ্য গড়ে তুলতে যারা সহায়তা করেছে তাদেরও নির্মূল করা জরুরি। এসব পাপরাজ্যের কারিগররা এক পাপিয়ায় যে সন্তুষ্ট থেকেছে তাও না হতে পারে। তাই আরও পাপিয়ারা আমাদের তরুণীদের জিম্মি করছে কিনা তা খুঁজে দেখা দরকার। সমস্যার গোড়ায় যাওয়া দরকার। এজন্য পাপিয়াদের নেপথ্যে যারা তাদেরও শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
তবে এ যাত্রায়ও সম্রাটের মতো হইচই হবে, সামাজিকমাধ্যমে তুলোধোনা হবে। কিন্তু গড ফাদার চিহ্নিত হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন, ‘ভাবছি সেসব মেয়ের কথা, চাকরি দেওয়ার নাম করে পাপিয়া যাঁদের তাঁর ক্ষমতাশালী খদ্দেরদের কাছে সরবরাহ করেছিলেন। সেই খদ্দেরদের নামধাম জানবে বা জানাবে, সেই সাধ্য এমনকি সাংবাদিকদেরও নেই।’
কিন্তু আমরা হতাশ হতেই চাই না। কথায় বলে, ‘চোরের দশ দিন, গৃহস্থের এক দিন’।
সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পাপিয়ার ক্ষমতার চিত্র যা দেখা গেল তাতে সরকারের আন্তরিকতা না থাকলে এমন খেলোয়াড় গ্রেফতার হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায়, ‘সরকারের সায় আছে বলে পাপিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে’। পাপিয়ার অপরাধের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে তদন্তে তাদের নাম বেরিয়ে আসবে বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আমরা সেই অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: পলাশ মাহমুদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, সময় নিউজ।