আমার বাবার নানা বাড়ীর গ্রাম হচ্ছে “রূপপুর”। পারমানবিক বিদ্যূতের স্বপ্ন দেখার কারণে যে গ্রাম আমার জন্মের আগেই উচ্ছেদ হয়ে গেছে। উচ্ছেদ হওয়া গ্রাম আবার নতুন করে বসেছে; সে গ্রামের নাম ” নতুন রূপপুর”। বর্তমানে আমার বাবার নানা বাড়ীর গ্রাম (বিবিসি বাজার) । বাবার কাছে শুনেছি রূপপুর গ্রাম নাকি ছিল আসলেই একটা রূপসী গ্রাম; যেন রূপের রাণী।
ছোট বেলায় যখন আমরা অনেক দিন পরপর আমার বাবার নানীবাড়ী আসতাম, তখন আসার আনন্দে কয়েকদিন আগে থেকেই আনন্দে আমরা মসগুল থাকতাম। আমাদের বাবার নানীবাড়ী যাবার শেষ অংশে থাকতো স্ক্রুটার বা ঘোড়াগাড়ীতে চাপা।
নতুন হাট মোড় পার হয়েই দেখতাম শ্রদ্ধেয় গফুর সাহেবের বাড়ী “মেহের আব”। তারপরই উৎকণ্ঠিত হতাম পাহাড় দেখবো বলে। কিছুক্ষণ পরেই চোখে ধরা দিত বহুল প্রত্যাশিত সেই পাহাড় উঁচু রেললাইন। রেললাইনের ওপারের উত্তর বঙ্গ কাগজ কলের সামান্য চূড়া দেখা যেতো।
নতুন রূপপুরের মসজিদ আমার কাছে লাগতো অনিন্দ্য সুন্দর। সবুজ ঘাসের মাঝে একটা দুধসাদা মসজিদ। যার মিনারটা ছিল আকাশ ছোয়া। মসজিদটাকে দেখে মনে হতো কোন সবুজ লেকে একটা সাদা রাজহাঁস ডানা মেলে একাকী ভেসে বেড়াচ্ছে আর সুউচ্চ মিনারটিকে দেখে মনে হতো সে গলা উঁচু করে তার সাথীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মসজিদের উত্তর পাশে আমার বাবার নানা বাড়ী, দক্ষিণে প্রাইমারি স্কুল পার হয়ে মাঠের পশ্চিমে আমার বাবার আরেক মামার বাড়ী। অর্থাৎ আমাদের নানার বড় ভাইয়ের বাড়ী। আমার বাবার নানার বাড়ী আমাদের কাছে পরিচিত ইব্রাহিম মন্ডল এর বাড়ী বলে। দিনের বেলায় যে আমাদের দুই বাড়িতে কতোবার যাতায়াত হতো, তার কোন হিসাব নেই। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দেখার নেশা উঠলে আমার বাবার নানা বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই একটা গভীর পুকুরের কাছে দৌড়ে যেতাম, সেখান থেকেই দেখা যেতো নদীর দুপাড় সংযোগকারী লাল রঙের ইস্পাতের সেতু। দেখে মনে হতো কবি যথার্থই বলেছেন “বিনা সুতোয় মালা গাঁথিছে নিতুই এপাড় ওপাড় দিয়া”।
নতুন রূপপুর গ্রামের পাশেই উঁচু বাঁধে দাঁড়িয়ে দেখতাম পরিত্যক্ত রূপপুর গ্রাম। কিন্তু ওখানে কেউ নিয়ে যেতোনা। একদিন ভাইজান আমাকে নিয়ে গেলেন। তিন বটতলার মোড় থেকে সোজা নেমে পাথর সড়ক অব্দি। পাথর সড়ক? ওখানে বিশাল বিশাল পাথরের বিশাল বিশাল স্তুপ। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। তাইতো এই নাম। পাথর সড়ক নিয়ে অনেক লোমহর্ষক গল্প শুনেছি। তাইতো ভয়ে সিটকে থাকি। তাইতো তাড়াতাড়ি ফেরৎ আসা হয়।
সেদিনই আমার বাবার মাতৃকূলের পূর্ব পূরুষের আদি ভিটে প্রথম দেখি। তিন বটতলার মোড় থেকে সোজা নেমে যেয়ে রাস্তার বা’পাশে সুন্দর লাল রঙের মসজিদ। যেহেতু তখন আর জনবসতি নেই সুতরাং নেই আর মসজিদটির জৌলুশও। মসজিদের পশ্চিমে মিম্বার সংলগ্ন একটা কবর। ভাইজানের কাছে জানলাম ওটা নানার বাবা মানে আমার মায়ের দাদার কবর। আর মসজিদ বরাবর রাস্তার ডানপাশে মাতৃকূলের আদিভিটে। যেখানে কয়েকটা নারকেল গাছ আর একটা পুরাতন কবর ছাড়া আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
অনেক দিন পর আবার গেলাম নতুন রূপপুর। অনেক কিছুর পরিবর্তন। নতুন হাট মোড় পাড় হয়ে এখন আর চোখে পড়েনা গফুর সাহেবের ” মেহের আব”। সে এখন লজ্জ্বায় অবগুণ্ঠিত। লুকিয়ে পড়েছে অন্যান্য ভবনের আড়ালে। রাস্তা থেকে এখন আর দেখা যায়না পাহাড় সদৃশ্য উঁচু রেলপথ। বৃক্ষ নিধনের মহোৎসবের দেশে এলাকাবাসী সৃজন করেছে বাগান। ফলে উঁচু উঁচু গাছের আড়ালে হারিয়ে গেছে রেললাইন। আর রেললাইন ভেদ করে দেখা যায়না এখন আর উত্তরবঙ্গ কাগজ কলের শিখর। কারণ ওটা এখন নিজেই ইতিহাসের অংশ।
নতুন রূপপুরের মসজিদটার উচ্চতা বেড়েছে। ফলে হারিয়ে যাবার পথে মিনারটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মসজিদের শ্বেতশুভ্র রঙও।
পাথর সড়কের পাথরও বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। রূপপুর গ্রামে এখন তিন শিফটে এগিয়ে চলছে পারমানবিক বিদ্যূৎ প্রকল্পের কাজ। যার কর্মযজ্ঞে ভেঙে পড়েছে লাল মসজিদটা। বিনিময়ে তিন বটতলায় বসেছে একটা টিনসেড মসজিদ
তারপরও আমি আশা করি নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণ শেষ করে সফলভাবে উৎপাদনে যাবে “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যূৎ কেন্দ্র”। যে বিদ্যূৎ ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। যার প্রভাবে/প্রভায় আলোকিত হয়ে উঠবে আমার বাংলাদেশ।
লেখকঃ সমিত জামান
সম্পাদকীয় সহকারী, সাম্প্রতিক সংবাদ