একাকিত্ব ও বিষাদ ছেয়ে গেছে। মানুষ সিনেমা ভুলেছে, খেলা ভুলেছে, রাজনীতিও ভুলেছে। ভুলেছে তার নিজস্ব পরিসর। একমুখী করোনা-চিন্তায় জীবন কাটাতে কাটাতে ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী মানসিক চাপ। করোনাভাইরাসের অজানা শঙ্কাই মূলত এর জন্য দায়ী।
করোনা ভাইরাসের দিনের পর দিন ঘরে থাকতে থাকতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপে থাকা মানুষদের জন্য করোনার ঝুঁকি বেশি। তাই এই করোনার কালে নিজেকে সুস্থ রাখতে প্রথমত থাকতে হবে চাপমুক্ত এবং একইসঙ্গে আত্মবিশ্বাসী।
এক ধরণের মানসিক চাপ আর নেতিবাচক প্রভাবে বাড়ছে মনো-সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে। এ নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক এই মহামারিতে মানসিক চাপ বোধ করা স্বাভাবিক।
করোনার কারণে মানসিক চাপে বা স্ট্রেসে আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন বা কাজ করতে পারছেন না, এমন পরিস্থিতি যেন না হয়, এজন্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক ও মনো-সামাজিক বিষয়গুলোর যত্ন নেওয়া সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
চাপিয়ে দেওয়া ঘরবন্দি মানুষের অবস্থায় অভ্যস্ত নয় মানুষ। আগে এমন অভিজ্ঞতা না থাকাও শরীরের স্ট্রেস হরমোনগুলিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। ফলে টেনশন, চাপা উদ্বেগ, ভয়, আতঙ্ক এগুলোই মাথার মধ্যে দপদপ করছে। অন্য কোনও ভাবনা স্থায়ী হচ্ছে না।
মন কিছুতেই বসছে না। এই সময়ও চারপাশে এটাই ঘটছে। তার সঙ্গে বাড়িতে বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ মানুষ থাকলে তাঁদের নিয়েও বাড়তি চিন্তা দানা বাঁধছে। উত্তেজিত হচ্ছে মোটর নিউরোন। এ সব থেকেই মনের চাপ বেড়ে চলেছে।
মানসিক চাপ কতটা ক্ষতি করতে পারে। কী কী রোগ হতে পারে। মানসিক চাপ বেড়ে গেলে, শরীরে ক্ষতিকর রাসায়নিকের রমরমা এতই হয় যে তার দাপটে প্রতিরোধ যোদ্ধাটি চলে যায় ব্যাকফুটে। তার উপর দুশ্চিন্তায় ঘুম কমে, খাদ্যাখাদ্য বিচার থাকে না, আগ্রহ থাকে না ব্যায়ামে। সবে মিলে প্রতিরোধ ক্ষমতার অবনতি হয়। এ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগীদের বেলায় অসুখ বেড়ে যাওয়ার ভয়ও বাড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, আরও অস্থিরতা ও বিরক্তি বাড়ে।’
কীভাবে ভাল থাকবেন দুশ্চিন্তার দিনেও, কী ভাবেই বা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন উদ্বেগ? উদ্বেগ থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার পাঠ জানতে হবে। আমাদের মন ভালো রাখতে হলে যেসব কাজ করতে হবে যেমন-
মন ভাল রাখে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। ছবি আঁকতে ভাল লাগলে, তাই করুন। গান গাইতে ভাল লাগলে তা-ই। রান্না করতে চাইলে সেটাই করুন। যার যে কাজে আনন্দ, তিনি তাতে কিছুটা সময় দিন। মন ভাল থাকবে। বাড়িতে থাকার সময় ভাল সিনেমা দেখুন, গান শুনুন, প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলুন, দেখতে দেখতে দিন কেটে যাবে।
মন বসাতে সমস্যা হলে রোজ সকালে একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, বাড়িতে বসে করা যায় এমন কিছু ব্যায়াম, বিশেষ করে মন ভাল রাখার যোগা, ডিপ ব্রিদিং, মেডিটেশন করুন। এতে রক্তচাপ কমবে, শরীর ফুরফুরে হবে, সঙ্গে মনও আনন্দ পাবে। মনে রাখুন, যা জানি না, যা আমার হাতে নেই, তা নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তার কোনও মানেই নেই। ভাবলেই কেউ বিপদ এড়াতে পারবেন না। তাই অহতুক ভেবে মাথার উপর চাপ বাড়ানো থেকে দূরে থাকুন। করোনা হওয়ার আগেও মানুষ মারা যেতেন, এর পরেও মানুষ মরণশীলই থাকবেন, রাস্তাঘাটে যে কোনও দুর্ঘটনাও অকালে প্রাণ কাড়তে পারে। তাই অযথা মৃত্যুভয় পাবেন না।
সব চিন্তা ফেলে রেখে পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে নিন ৷ ক্লান্তি ও চিন্তা দূর করার জন্য ঘুম অত্যন্ত দরকার৷
অপরাধবোধ চিন্তা দূরে রাখুন৷ মানুষ মাত্রই ভুল করে৷ তাই অতীত নিয়ে বেশি ভেবে নিজের ভালো সময় নষ্ট করবেন না। বুকভরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিন। এটা চাপ কমাতে ও মন শান্ত করতে সাহায্য করে।
ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করুন, ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে খান। টেনশন কমাতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
মনে রাখবেন,যে কোন মানসিক চাপে শিশুরা বড়দের চাইতে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়; তারা ববা-মাকে আকড়ে ধরে রাখতে চায়, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, রাগ করে, অস্থির হয়ে উঠে কিংবা বিছানায় প্রসাব করে। শিশুর মানসিক চাপজনিত এই প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতি আপনি সাহায্যেও হাত বাড়িয়ে দিন , তাদের কথাগুলো মন দিয়ে আন্তরিকতার সাথে শুনুন, তাদেরকে একটু বেশি ভালোবাসা দিন এবং তাদের প্রতি মনোযোগী হোন।
বিরুপ পরিস্থিতিতে শিশুরা বড়দের ভালোবাসা আর মনোযোগী একটু বেশি চায়। এই সময় আরেকটু বেশি সময় দিয়ে তাদের প্রতি মনোযোগী হোন। শিশুদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন, তাদেরকে আশ্বস্ত করুন এবং তাদের প্রতি সদয় হয়ে কথা বলুন। যদি সুযোগ থাকে তবে শিশুটিকে খেলতে দিন এবং তাকে চাপমুক্ত রাখুন।
যতদূর সম্ভব, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সকল পর্যায়ে শিশুকে তার মা-বাবা এবং পরিবারের সাথেই রাখুন এবং তাদেরকে পরিবার বা যত্ন প্রদানকারীদের কাছ থেকে আলাদা করা থেকে বিরত রাখুন। হাসপাতালে ভর্তি, কোয়ারেন্টাইন বা যে কোন কারণে যদি আলাদা করতেই হয় তবে টেলিফোন বা অন্য মাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করুন এবং শিশুদের নিয়মিত আশ্বস্ত করুন।
প্রতিদিনকার নিয়মিত রুটিন আর পরিকল্পনামাফিক কাজগুলো যতদূর সম্ভব আগের মতই বজায় রাখার চেষ্টা করুন অথবা প্রয়োজন হলে নতুন পরিবেশে নতুন রুটিনমত কাজ করে যেতে শিশুদের সাহায্য করুন; যেমন স্কুলে যাওয়া, পড়ালেখা করা, নিরাপদে খেলা এবং বাড়তি চাপমুক্ত থাকা।
যা হচ্ছে সে বিষয়েয শিশুকে তার বয়স উপযোগী করে প্রকৃত সত্য তথ্য প্রদান করুন , তাদেরকে প্রতিকূল পরিস্থিতির ব্যাখা দিন কিভাবে সে নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পারবে এবং সংক্রমণ থেকে দূরে থাকবে সেগুলো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলুন।
সংক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে তাকে আগাম তথ্য জানিয়ে রাখুন এবং শিশুর নিরাপত্তা বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করুন। যেমন- শিশু বা তার পরিবারের কেউ যদি অসুস্থ বোধ করে এবং হাসপাতালে ভর্তিও প্রয়োজন হয় তবে সেটি শিশুকে আগে থেকে জানিয়ে দিন, সেই সাথে জানান যে এতে আতংকিত হবার কিছু নেই, তাদেও সুস্থতার জন্য চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।