মূল্যবোধ ব্যাপারটা উপলব্ধি করা বেশ কঠিন। মূল্যবোধের সংজ্ঞা কি? মোতাহার হোসেন লিখেছেন: মূল্যবোধের লক্ষণ হলো ‘নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক য’ন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতী’ক্ষা ও ক্ষ’তি স্বীকার করতে শেখা’ আর যুক্তিবিচার হলো ‘জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা’।
এই সময়ে সমাজের দিকে তাকালে লাভজনক য’ন্ত্রবিদ্যার পূ’জারি ছাড়া আর কিছু কি আমরা দেখতে পাই? স্বভাবতই কথা সত্য যে এই শ্রেণির পূজারিদের মাঝে যুক্তিবিচার বলতে কিছু থাকে না। তাদের বিচারবুদ্ধি স্বার্থের দ্বারা কলঙ্কিত হয়, নিকটবর্তী স্থূল সুখই তাদের কাম্য। তাদের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, অসুন্দর আরামই তাদের উদ্দেশ্য। আমাদের চারপাশেই এর বিচরণ ও বাস। এমনকি তিনিও হতে পারেন যিনি আপনার সকাল-সন্ধ্যার আড্ডার সাথি।
এরা বৃহতের অকল্যাণ করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, মানবতা ক্ষণে ক্ষণে তাদের মাধ্যমে পদদলিত হয়। যুক্তি বিচার আর মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে দূরবর্তী সূ’ক্ষ্ম সুখ আর সৌন্দর্যই প্রধান, নিজ স্বার্থ কোনো বিষয় নয়-অপরের কল্যাণই যেন বড়। এরা আ’ইনকে অ’বজ্ঞা নয়, মেনে চলে যদিও সেটি ক্ষু’দ্রাতিক্ষুদ্রও হয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরুন কোনো একজন অর্থ-বিত্তে বেশ এগিয়েছেন। তিনি তার আরাম-আয়েশের জন্য গাড়ি কিনবেন। এ ক্ষেত্রে গাড়ি কেনার আগে একটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে আর সেটি হলো গাড়ি চালনা করবেন কে? তিনি কি নিজেই চালাবেন নাকি ড্রাইভার দিয়ে চালাবেন। সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা। কারণ, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো অ’বৈধ আর অ’নৈতিক।
কিন্তু ভেবে দেখুন, এই অ’নৈতিক কাজটিই অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ দিনের পর দিন করে যাচ্ছেন অবলীলায়। এতে আরাম হচ্ছে ঠিকই কিন্তু হারাচ্ছে সৌন্দর্য। কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে হেয় করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়, হাতের কাছেই একটি উদাহরণ আছে উচ্চশিক্ষিতরাও কীভাবে সৌন্দর্যকে নষ্ট করে। এ রকম নজির আজকাল যত্রতত্রই পাওয়া যায়। সে জন্য বিশেষ কোনো খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন হয় না।
কথার প্রয়োজনে আরও একটি কথা এখানে বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। তবে বলে রাখা ভালো, সব শিক্ষিতের ভেতরই যে এই দুটো জিনিস পুরোপুরিভাবে থাকবে এমন কোনো কথা নেই। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমারবৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনি তাদের মাধ্যমে মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার চর্চা কখনো সম্ভব হবে না।
সুশিক্ষিত নিরূপণের কোনো স্কেল আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সুশিক্ষিতের একটা সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে আর তা হলো-সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে কাজে লাগান। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অ’যৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্রতী হন।
তার অর্থ এই, সুশিক্ষা আর যুক্তিবিচার দুটি সমান্তরালে চলে আর তার মধ্যে যথেষ্ট মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। যিনি যতটুকু সুশিক্ষিত তিনি ততটুকু যৌক্তিক এবং তিনি আরাম অপেক্ষা সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আর যারা এর ধার ধারেন না তারা তাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি যুক্তিবিচারের বাইরে গিয়ে যে কোনো উপায়েই হোক পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
এই গোত্রের মানুষগুলো বি’পজ্জনক এবং এরা একপর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়ার জন্য অনেকটা একরোখা আচরণ করেন। যৌক্তিকতাকে আমলে নিতে চান না বা নেন না। যাকে অনেকটা গোঁয়ারতুমি বলা চলে। সমাজে-সংসারে এই সংখ্যাটা অনেক এবং তাদের আধিক্যের কারণে সুশিক্ষিত মানুষগুলো তাদের কাছে প্রতিনিয়ত ঠকে, লা’ঞ্ছিত হয় এবং সর্বোপরি সমাজ-সংসারে কো’ণঠাসা হয়ে থাকে। প্র’তিবাদী হয়ে মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার ঘটানো না গেলে এর থেকে পরিত্রাণ দুঃসা’ধ্য।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, কলামিস্ট, সংবাদ কর্মী, পিএ সাবেক গণপূর্ত মন্ত্রী।