সিরাজুর রহমানঃ সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের সোস্যাল মিডিয়ার পেজ ও গ্রুপগুলোতে প্রচার করা হয় যে, ভারতের কোলকাতার লোকেরা নাকি এতই কৃপণ যে, এক ইলিশ মাছ সাত জনে মিলে কিনে খায়। সেখানকার বাজারে নাকি হাজার টাকা মূল্যের এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ কেটে কেটে ১০০, ২০০ কিংবা ২৫০ গ্রাম ওজন করে বিক্রয় করা হয়। এই নিয়ে দেখলাম আবার আমাদের দেশের কিছু অতি উৎসাহী ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্টের পাশাপাশি ব্যাপক হাসাহাসি এবং উপহাস কিংবা বিদ্রুপ করে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন। আসলে বিষয়টিকে আমরা না বুঝেই এক তরফাভাবে নেতিবাচক হিসেবে নিয়ে যতটা সম্ভব ট্রল করতে ব্যস্ত রয়েছি।
কিন্তু আমি মনে করি, ভারতের কোলকাতার লোকেরা যদি সত্যই ইলিশ মাছ কিংবা অন্যান্য খাদ্য এভাবে অল্প করে কেটে কেটে কিনে খান তাহলে তা কিন্তু তারা একদম ঠিক কাজ করছেন। আর এতে তো দোষের কিছু থাকতে পারে না। এখানে তাদের ইলিশ মাছ কেটে কেটে বিক্রয় বা কেনার বিষয়টিকে নিয়ে হাসাহাসি বা উপহাসের কি আছে তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কারণ এটা একটা মিতব্যয়িতা বা অপচয় রোধ করার একটি উপায় হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি। তাছাড়া মনে রাখবেন, অল্প করে কেনা বা মিতব্যায়িতার মাধ্যমে বাজারে অবৈধ সিণ্ডিকেট ব্যবসা খুব সহজেই প্রতিহত করা সম্ভব। তা নিয়ে অহেতুক অন্য দেশের মানুষ বা জাতিকে নিয়ে ট্রল করাটা একেবারেই নিকৃষ্ট এবং নিম্ন মন মানসিকতার পরিচয় বহন করে। যা আমাদের সকলকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। নাকি শুধু ভারত বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করতে পারলেই কেবল নিজেকে বিশ্ব মানের দেশ প্রেমিক হিসেবে প্রমান করা যায়?
আচ্ছা ভাবুন তো আমাদের দেশে মধ্যবৃত্ত এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো সারা বছরে কয়টি ইলিশ মাছ কিনে খেতে পারেন। আমি নিজেই তো বিগত পাঁচ বছরে একটি ইলিশ মাছ কিনেছি বলে আমার মনে পড়ে না। এমনো পরিবার দেখা যায় সারা বছর তো দূরের কথা এক দশকেও ৮০০ টাকা বা ১,০০০ টাকা দামের ইলিশ মাছ কিনে খেতে পারেন না বা আর্থিকভাবে তেমন একটা সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাছাড়া আমাদের দেশে ইলিশ মাছ কেটে বাজারে বিক্রি করার কোন প্রচলন বা ব্যবস্থা নেই। আর আমাদের দেশের বাজারগুলোতে যদি দেশের জাতীয় সম্পদ ইলিশ কেটে কেটে বিক্রি করার কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আমাদের মতো অনেক সাধারণ মানুষ অল্প করে কিনে হলেও ইলিশ মাছ খাওয়ার সুযোগ পেতেন। ১,০০০ টাকা কেজি ওজনের দামে একটি ইলিশ কেটে বিক্রয় করলে ২০০ গ্রামের দাম পড়ে ২০০ টাকা। সেদিক বিবেচনা করলে আমরা অল্প হলেও সাধ্যের মধ্যে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেতম। আর ভারতের লোকেরা ইলিশ মাছ আমাদের দেশে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে আমাদের বাংলাদেশই তো আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। বিষয়টি আসলে তাই নয় কি?
এবার আমি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আচ্ছা আপনারা বলুত তো যারা ইলিশ মাছ ধরেন ও ব্যাবসার সাথে জড়িত তারা বাংলাদেশের কোন পদ্মা কিংবা মেঘনা নদী আমাদের সরকারের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা দিয়ে ইজারা বা লিজ নিয়ে ইলিশ চাষ করছেন, যাতে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ৮০০ টাকা কিংবা ১,০০০ টাকা থেকে ১,২০০ টাকা দাম পড়ে যায়। নাকি তারা বাংলাদেশের সব নদ-নদী লিজ নিয়ে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা উৎপাদন ব্যয় করে ইলিশ মাছ চাষ করেন, যাতে আমাদের দেশের জাতীয় সম্পদ ইলিশ এতো বেশি দাম দিয়ে কিনে খেতে হবে। এর জবাব আদৌ কারো কাছে আছে বলে মনে হয় না।
অথচ আমার গ্রামে একজন সাধারণ মাছ চাষী ৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করে তিন বছরের জন্য ৪ বিঘা মাপের পুকুর লিজ নিয়ে আরো লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ভালো জাতের (রুই/কাতল) মাছ চাষ করে বছরে আনুমানিক দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা আয় করেন। সেই মাছ স্থানীয় বাজারে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন কিংবা তা একাধিক ব্যাবসায়ীর হাত ঘুরে ঢাকার বাজার পর্যন্ত পৌছে এর দাম সর্বোচ্চ ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি প্রতি হয়ে থাকে। তাহলে প্রকৃত কোন উৎপাদন খরচ না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নদীতে মাছ ধরা, তা সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন আড়তদারের হাত ঘুরে ইলিশের দাম এত বেশি কেন হবে তা ঠিক আমার বোধগোম্য নয়।
আমাদের জাতীয় সম্পদ ইলিশ মাছ তো মহান আল্লাহ তালার অসীম নেয়ামত স্বরুপ আমাদের দান করেছে। তাহলে কোন যুক্তিতে এর দাম এত বেশি হয়? কারো কাছে কি এর কোন সঠিক জবাব জানা আছে কি? নাকি নদী থেকে মাছ ধরতে এবং তা বরফে সংরক্ষণ করতে এবং সারা দেশব্যাপী পৌছে দিতে হাজার কোটি টাকা লেগে যায়। যার জন্য চাঁদপুর থেকে আমাদের নাটোরে আসতে ৫০০ টাকার ইলিশ এক লাফে ১,০০০ টাকায় পৌছে যায়। আর এসবের আসল ও শক্ত জবাব হলো একেবারেই না। এখানে আসলে কিছু অতি মুনাফা লোভী ও অসাধু ইলিশ মাছ মজুতদার ও ব্যাবসায়ীরা বিভিন্ন স্তরে সিন্ডিকেটের মাধম্যে বিভিন্ন অপকৌশলে প্রতি নিয়ত আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের ইচ্ছে মতো হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটে নিতে ব্যস্ত রয়েছে। কই আপনার তো এই অশুভ সিণ্ডিকেট নিয়ে কোন লেখালিখি করেন না কিংবা গণ সচেতনতা মুলক পোস্ট দেন না। আবার এসব অনিয়ন, অবিচার, দূর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ তো জেড়ালো প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না।
আবার আমাদের দেশে শতাধিক আড়তে হাজার হাজার টন পেঁয়াজ অবৈধভাবে মজুত করে কৃত্রিক অভাব ও সিন্ডিকেটের মাধম্যে আমাদের ৪০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি বা আমাদের কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর আমরা তো এই পেঁয়াজের অবৈধ মূল্য বৃদ্ধিকে কোন ভাবেই ঠেকাতে পারছি না। বরং এখন কিনা আমরা এক রকম মেনেই নিয়েছি যে, বাংলাদেশে যে কোন দ্রব্যের দাম যে কোন মুহুর্তে বৃদ্ধি পেতেই পারে। যদিও অবশ্য আমাদের সম্মানিত সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ থেকে লক্ষাধিক টন পেঁয়াজ আমদানি করে দেশের পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাই অহেতুক অন্য দেশ বা জাতিকে উপহাস বা বিব্রত না করে আমাদের বরং নিজের সমাজ ও দেশকে কিভাবে সিণ্ডিকেট মুক্ত, স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখা যায় তা নিয়ে দেশের সম্মানিত সরকারকে সহায়তার পাশাপাশি নিজেকেও মেধা ও শ্রম দিয়ে কাজ করে যাওয়ার বিকল্প কিছু থাকতে পারে না।